রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪
407 আবুল বাশার :- আজ ১৭ এপ্রিল।বাঙালী জাতির ইতিহাসের এক মহত্তম দিবস । সহস্র বছরের সাধনা শেষে জাতি হিসেবে প্রথম বাঙালীদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণের দিন। বাঙালীর স্বাধীনতা অর্জনের ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের অনন্য দিন। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ভিত্তি রচনার দিন। ইতিহাসের পাতায় দিবসটি ‘মুজিবনগর দিবস’ হিসেবে চিরস্মরণীয়। জাতির বীরত্বগাথা সৃষ্টির এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত ছিল দিনটি। কত শত সংগ্রাম, আন্দোলন, ত্যাগ-তিতিক্ষা, বিদেশী ও ঔপনিবেশিক এবং দখলদার শাসকের জেল-জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, ত্রাসন সয়ে বাঙালী যে তার স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল- এই দিনটি সেই আনুষ্ঠানিকতাকে ধারণ করে মুক্তির লড়াইকে ত্বরান্বিত করেছিল মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে। ১৯৭১ সালের এই দিনে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথগ্রহণ করে। স্থানটির নামকরণ হয় মুজিবনগর। এছাড়াও বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষের প্রতি ভারতের সরকার ও জনগণের ছিল ঐতিহাসিক সমর্থন। মূলত ভারতের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সমর্থনেই ১০ এপ্রিল ১৯৭১ দেশত্যাগী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেন। 'মুজিবনগর সরকার' নামে খ্যাত সেই সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ অনুষ্ঠান হয় ১৭ এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলায়, যা পরে 'মুজিবনগর' নামে পরিচিত হয়েছে। এই সরকারের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়েছে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ। কয়েক শ ভারতীয় ও পশ্চিমা সাংবাদিকের উপস্থিতিতে ১৭ এপ্রিলের ঐতিহাসিক শপথগ্রহণ হয়, তা সঞ্চালন করেন সেদিনকার আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নান এমএনএ এবং স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন সেদিনকার আওয়ামী লীগ নেতা ও এমএনএ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। ঝিনাইদহের এসডিপিও এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ও মেহেরপুর মহকুমার এসডিও বীর মুক্তিযোদ্ধা তওফিক এলাহী চৌধুরী মন্ত্রিসভাকে 'গার্ড অব অনার' প্রদান করেন। সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অসমসাহসী যোদ্ধা মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। 5 বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতিতেই সম্পূর্ণ বৈধ ও গণতান্ত্রিক পন্থায় যুদ্ধরত দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা থাকেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ। এই সরকারের অধীনে কর্নেল এম এ জি ওসমানী হন প্রধান সেনাপতি। মুজিবনগর সরকার ছিল পরিপূর্ণ সরকার।স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথ হওয়ার কথা ছিল প্রথমে ১৪ এপ্রিল এবং স্থান নির্ধারিত হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায়। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয় এবং বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করতে থাকে। এতে পরিকল্পনা পাল্টাতে হয়। বাংলাদেশের নেতারা এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে বসে। কারণ এমন একটি জায়গায় শপথ অনুষ্ঠানটি করতে হবে, যা সম্পূর্ণ নিরাপদ।শেষ পর্যন্ত নানা দিক বিবেচনায় সেদিনকার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলাকে উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু শপথগ্রহণের বিষয়টি অত্যন্ত গোপনে রাখা হয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সুব্রত রায় চৌধুরী আমীর-উল ইসলাম প্রণীত ঘোষণাপত্রের খসড়াটি দেখেন এবং সমর্থন দান করেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিশেষত বিএসএফের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শপথ অনুষ্ঠানটির আয়োজন চলতে থাকে। কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও কর্নেল এম এ জি ওসমানী একটি গাড়িতে সীমান্তের পথে রওনা হন। নির্ধারিত স্থান, অর্থাৎ আম্রকাননে পৌঁছতে সকাল ১১টা বেজে যায়। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় নতুন ইতিহাস।কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। Provisional_Government_of_BD একটি ছোট্ট মঞ্চে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ, ওসমানীসহ কয়েকজন ওঠেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। সে ভাষণের খসড়া আগেই প্রস্তুত করা হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল অস্থায়ী সরকারের রাজধানী। মেহেরপুরের এই বৈদ্যনাথতলা বাংলাদেশের ইতিহাসের পবিত্র স্থান। স্থানটি সেদিনকার মেহেরপুর মহকুমার অধীনে ১০৫ নম্বর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পিলারের সঙ্গে লাগোয়া। সেদিনকার অনুষ্ঠানে বিদেশি সাংবাদিক ও শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ছাড়াও আশপাশের এলাকার হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। যখন শপথগ্রহণ চলছিল তখন হাজারো কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল 'জয় বাংলা/জয় বঙ্গবন্ধু', 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/বাংলাদেশ স্বাধীন কর' স্লোগান। 0000 ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে মুজিব নগরে শপথ অনুষ্ঠান শেষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিসৈয়দ নজরুল ইসলামের সংক্ষিপ্ত ভাষণ :- আজ এই আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিল। বিগত বহু বছর যাবত বাংলার মানুষ, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-অধিকার নিয়ে এগুতে চেয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থ কখনই তা হতে দিল না। ওরা আমাদের ওপর আক্রমন চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে চেয়েছিলাম, ওরা তা দিল না। ওরা আমাদের উপর বর্বর আক্রমন চালাল। তাই আজ আমরা লড়াইয়ে নেমেছি। এ লড়াইয়ে আমাদের জয় অনিবার্য। আমরা পাকিস্তানী হানাদারদেরকে বিতাড়িত করবোই। আজ না জিতি কাল জিতিবো। কাল না জিতি পরশু জিতবোই। আমরা বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সাথে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান চাই। পরস্পরের ভাই হিসেবে বসবাস করতে চাই। মানবতার, গণতন্ত্রের এবং স্বাধীনতার জয় চাই।-----------------------------আমাদের রাষ্ট্রপতি জননন্দিত মহাপুরুষ, নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব। তিনি বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে আজ কারাগারে বন্দী। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই’ 00000 গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহন অনুষ্ঠানে সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ :- আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই যে, তারা আমাদের আমন্ত্রণে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি দেখে যাবার জন্য বহু কষ্ট করে, বহু দূর-দূরান্ত থেকে এখানে উপস্থিত হয়েছেন।আমি কিছু বলবার আগে প্রথমেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদের সংবাদপত্রসেবী এবং নিউজ এজেন্সির প্রতিনিধিদের যে, তারা বাংলাদেশের সাড়ে-সাতকোটি মানুষের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে আগাগোড়া সমর্থন দিয়ে গিয়েছেন এবং সত্য কথা প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন। যদিও ইয়াহিয়া সরকার তাদেরকে এবং তার সেই দস্যুবাহিনী বিদেশি সাংবাদিকদের ভেতরে আসতে দেয়নি, যারা ভেতরে ছিলেন তাদের জবরদস্তি করে ২৫ তারিখ রাতেই বের করে দিয়েছেন। আমি আপনাদের আরো ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই জন্য যে, আমার বাংলাদেশের সাড়ে-সাতকোটি মানুষের সংগ্রম, স্বাধীনতা সংগ্রাম, সেই সংগ্রাম কোন অবস্থাতেই যাতে ব্যহত না হয় এবং কোন অবস্থাতেই সে সংগ্রামকে ভুল ব্যাখা না দেয়া হয় সে জন্য আপনার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, সঠিক পথ দেখিয়েছেন। আমি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সাড়ে-সাকোটি মানুষের পক্ষ থেকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে আবেদন জানাবো ভবিষ্যতেও আপনার দয়া করে চেষ্টা করবেন যাতে সঠিক সংবাদ পরিবেশিত হয়, যাতে কোন দুস্কৃতিকারী বা কোনো শত্রু বা এজেন্ট ভুল ব্যাখা দিয়ে আমাদের আন্দোলনের কোনো রকম ভুল ব্যাখ্যাকরতে না পারে, বূল বুঝামত না পারে। সেই সাথে আমি আপনারে অনুরোধ জানাবো আমাদের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে হ্যান্ড আউট যাবে সেটাকেই বাংলাদেশ সরকারের সঠিক ভাষ্য বলে ধরে নেবেন। আর আমি আপনাদের আরো একটি অনুরোধ জানাবো, জানিনা সেটা কিভাবে সম্ভব হবে, আমাদের বাংলাদেশের মাটি থেকে আপনারা কিভাবে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারবেন, কিভাবে বাংলাদেশ সরকারের সাথে লিয়াজো করতে পারেন সেব্যাপারে আপনারা চিন্তা করে দেখবেনএবং সে ব্যাপারে আপনাদের পরামর্শ আমরা অত্যান্ত সাদরে, আনন্দের সাথে গ্রহন করবো। এখন আমি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের ভাষ্য তুলে ধরবো।“বাংলাদেশ সরকার এখন যুদ্ধে লিপ্ত” পকিস্তানের ঔপনিবেশবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আত্ন-নিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন ছাড়া আমাদের হাতে আর কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশের গণহত্যার আসল ঘটনাকে ধামা-চাপা দেয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারের মুখে বিশ্ববাসীকে অবশ্যই জানাকত হবে কিভাবে বাংলার শান্তিকাসম মানুষ শসস্ত্র সংগ্রাসমর পরিবর্তেসংসদীয় পদ্ধতিকে বেছে নিয়েছিল। তবেই তারা বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আশা আকাঙ্কাকে সত্যিকারভাবে উপলদ্ধি করতে পারবেন। পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি রক্ষঅর চেষ্টা হিসেবে আওয়ামীলী পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে ৬ দফার আলোকে বাংলাদেশের জন্য স্বোয়ত্বশাসন চেয়েছিলেন। ১৯৭০ এ আওয়ামীলীগ এই ৬ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তিতেই পাকিস্তান জাতীয পরিষদের মোট-৩১৩ টি আসনের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ ১৬৯ টি আমনের মধ্যে মোট ১৬৭ টি আসন লাভ করেছিল। নির্বাচনের বিজয় এতই চূড়ান্ত ছিল যে, আওয়ামীলীগ শতকরা ৮০ টি ভোট পেয়েছিল। এই বিজয়ের চূড়ান্ত রায়েই আওয়ামীলীগ জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেছিল। স্বভাবতই নির্বাচন পরবর্তী সময়টি ছিল আমাদের জন্য এক আশাময় দিন। কারন সংসদীয় গণতন্ত্রে এমনি চূড়ান্ত রায় ছিল অভূতপূর্ব। এই দুই প্রদেশেরেই লোক বিশ্বাস করেছিলেন যে, এবার ৬ দফার ভিত্তিতেই উভয় প্রদেশের জন্য একটি গ্রঞনযোগ্য গঠণতন্ত্র প্রণনয়ন সম্ভব হবে। তবে সিন্ধু ও পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারি পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি তাদের নির্বাচনী অভিযানে ৬ দফাকে এড়িয়ে নিয়েছিল। কাজেই ৬ দফাকে গ্রহণ বা প্রত্যাখান করার জন্য জনগনের কাছে তাদের কোন জবাবদিহি ছিল না। বেলুচিস্থানে নেতৃস্থানীয় ন্যাশনাল আওয়ামীপার্টি ছিল ৬ দফার পূর্ন সমর্থক। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রভাশালী ন্যাশনাল আওয়ামীপার্টি ৬ দফার আলোকে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসনে বিশ্বাসী ছিল। কাজেই প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাজয় সূচনাকারী ৭০-র নির্বাচনে পাকিস্তান গণতন্ত্রের আশাপদ ভবিস্যতরেই উঙ্গিত বহন করেছিল। আশাকরা গিয়েছিল যে, জাতীয় পরিষদ আহ্বানের প্রস্তুতি হিসেবেপ্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুরো আলোচনায় বসেবে। এমনি আলোচনার প্রস্তাব এবং পাল্টা প্রস্তাবের ওপর গঠনতন্ত্রের ব্যাখ্যা উপস্থাপনের জন্য আওয়ামীলীগ সবসময়ই সম্মত ছিল। তবে এই দল বিশ্বাস করেছে যে, যথার্ত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জাগ্রত রাখার জন্য গোপনীয় সম্মেলনেরা পরিবতর্তে জাতীয় পরিষদেই গঠনতন্ত্ররে ওপর বিতর্ক হওয়া উচিত। এরই প্রেক্ষিতে আওয়ামীলীগ চেয়েছিল যথাস্বত্তর জাতীয় পরিষদ আহবানের জন্য।আওয়ামীলীগ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে উপস্থাপনের লক্ষে একটি খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণনয়নের কাজে লেগে গেল এবং এ ধরনের একটি গঠনতন্ত্র প্রণনয়নের সব আইনগত এবং বাস্তব দিকও তারা পরীক্ষ করে দেখলো। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর আলোচনার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারি ৭১’র মাঝামাঝি সময়ে। এই বৈঠকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামীলীগের ৬ দফা ভিত্তিক কর্মসূচিকে বিশ্লেষণ করলেন এবং ফল কি হতে পারে তারও নিশ্চিত ভরসা নিলেন আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে। কিন্তু প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্র সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান তার নিজস্ব মন্তব্য প্রকাশে বিরত থাকলেন। তিনি এমন ভাব দেখালেন যে, ৬ দফায় সাংঘাতিক আপত্তিজনক কিছুই খুঁজে পাননি। তবে পাকিস্তান পিপলস পার্টির সাথে একটি সমঝোতায় আসার ওপর তিনি জোর দিলেন। পরবর্তী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও আওয়ামীলীগের সাথে ঢাকায় ২৭ শে জানুয়ারি ১৯৭১ । জনাব ভুট্ট এবং তার দল আয়ামীলীগের সাথে ঘঠনতন্ত্রের ওপর আলোচনার জন্য এ সময় কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হন। ইয়াহিয়ার ন্যায় ভুট্টোও গঠনতন্ত্রের অবকাঠামে সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আননয়ন করেননি। বরং তিনি তার দল ৬ দফার বাস্তব ফল কি হতে পারে সে সম্পর্কে আলোচনার প্রতি অধিক ইচ্ছুক ছিলেন। যেহেতু এব্যপারে তাদের প্রক্রিয়া ছিল না সূচক, এবং যেহেতু এ নিয়ে তাদের কোন তৈরি বক্তব্যও ছিল না, সেহেতু, এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আপস ফরমূলায় আসাও সম্ভব ছিল না। তথচ দুই দলের মধ্যে মতানৈক্য দূর করার জন্য প্রচেষ্টার দূয়ার সমসময়ই খোলা ছিল। এই আলোচনা বৈঠক থেকে এটাই স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কোন পর্যায় থেকে আপোস ফরমুলায় আসা সম্ভব সে সম্পর্কেও জনাব ভুট্টোর নিজস্ব কোন বক্তব্য ছিল না। এখানে একটি কথা আরো পরিস্কারভাবে বলে রাখা দরকার যে, আওয়ামীলীগের সাথে আলোচনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এ ধরনের কোন আভাসও পাকিস্তান পিপলস পার্টি ঢাকা ত্যাগের আগে দিয়ে যায়নি। উপরন্ত তরার নিশ্চয়তা দিয়ে গেলেন যে, আলেচনার জন্য সব দরজাই খোলা রয়েছে এবং পিপলস পার্টি আওয়ামীলীদগর সাথে দ্বিতীয় দফা আরো অধিক ফলপ্রসু আলোচনায় বসবেন, অথবা জাতীয় পরিষদে তারা ভিন্নভাবে আলোচনায় বসার জন্য অনেক সূযোগ পাবেন। পরবর্তী পর্যায়ে জনাব ভুট্টোর জাতীয় পরিষদের অধিবেশণ বয়কটের সিন্ধান্ত সবাইকে বিস্মিত ও হতবাক করে। তার এই সিন্ধান্তের জন্যই সবাইকে আরো বিস্মিত করে যে, শেখ মুজিবের দাবি মোতাবেক ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশণ আহবান না করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টোর কথামতই ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেছিলেন। পরিষদ বয়কটের সিন্ধান্ত ঘোষণার পর পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিয়ান শুরু করেন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল তাদের পরিষদের অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত রাখা। এ কাজে ভুট্টোর হাতকে শক্তিশালি করার জন্য জাতীয় নিরপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ট সহচর লে. জেনারেল ওমর ব্যাক্তিগত ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের ওপর পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। জনাব ভুট্টো ও লে. জেনারেল ওমরের চাপ স্বত্তেও পি.পি.পি ও কাইউম লীগের সদস্যগণ ব্যতীত অপরাপর দলের সমস্ত সদস্যই ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য বিমানে পূর্ববাংলা আগমেন জন্য টিকিট বুক করেন। এমন আশ্বাসও পাওয়া যাচ্ছিলো যে, পি,পি,পি ,র বহু সদস্য দলীয় সিন্ধান্তের বিরুদ্ধে ঘোষণা করে ঢাকায় আসতে পারেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এমন যুক্তফ্রন্ট গঠন করেও যখন কূল কিনারা পাওয়া যাচ্ছিলো না, তখন ১ লা মার্চ অনির্দিস্ট কালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষনা করেন জেনারেল ইয়াহিয়অ তার দোস্ত ভুট্টোকে খুশি করার জন্য। শুধু তাই নয় , জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ববাংলার গভর্নর আহসানকেও বরখাস্ত করলেন। গভর্নর আহসান ইয়াহিয়া প্রশাসনে মধ্যপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন। বাঙালিদের সংমিশ্রণে কেন্দ্রে যে মন্ত্রীসভা গঠিত হয়েছিল তাও বাতিল করে সরকারের সমস্ত ক্ষমতা পাকিস্তানি মিলিটারি জান্তার হাতে তুলে দেয়া হলো। এমতাবস্থায় ইয়াহিয়ার সমস্ত কার্য়ক্রমকে কোনক্রমেই ভুট্টোর সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে বাংলাদেশের গণ-রায় বানচাল করার প্রয়াস ছারা আর কিছু ভাবা যায় না। জাতীয় পরিষদই ছিল একমাত্র স্থান যেখানে বাংলাদেশ তার বক্তব্য কার্যকরি করতে পারতো এবং রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শণ করতে পারতো। এটাকে বানচাল করার জচষ্টা চলতে থাকে। চলতে থাকে জাতীয় পরিষদকে সত্যিকার ক্ষমতার উৎস না করে এটা “ঠুটো জগন্নাথে’ পরিণত করার। জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের প্রক্রিয়া যা হবে বলে আশংকা করা হয়েছিল তািই হয়েছে। ইয়াহিয়ার এই সৈরাচারি কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সরা বাংলাদেশের মানুষ সতঃস্ফুর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। কেনানা বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে,ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন ইচ্ছাই ইয়াহিয়া খানের নেই এবং তিনি পার্লাসমন্টারি রাজনীতির নামে তামাশা করছেন। বাংলাদেশের জনগন এটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল যে, এক পাকিস্তানের কাঠাসমাতে বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের কোন সম্ভাবনা নেই। ইয়াহিয়া নিজেই আহবান করে আবার নিজেই যে ভাবে জাতিয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন তা থেকেই বাঙালি শিক্ষা গ্রহন করেছে। তাই তারা একবাক্যে পূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপ দিতে থাকেন। শেখ মুজিব এতদস্বত্ত্বেও সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। ৩ মার্চ অসহযোগ কর্মসূচির আহবান জানাতে গিয়ে তিনি দখলদার বাহিনীকে মোকাবিলার জন্য শান্তির অস্ত্রই বেছে নিয়েছিলেন। তিনি তখনো আশা করছিলেন যেম সামরিক চক্র তাদের জ্ঞানবুদ্ধি ফিরে পাবে। গত ২ মার্চ ও ৩০ মার্চ ঠান্ডা মথায় সমারিক চক্র কতৃক হাজার হাজার রনরস্ত্র ও নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করার মুখে বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের নজির পৃথিবীর ইতিহাসের বিরল। শেখ সাহেবের অসহযোগ আন্দোলন আজ ইতিহাসের অনতর্গত। অসহেযোগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টি করলেন এক নতুন ইতিহাস। বাংলাদেশে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন যে ভাবে এগিয়ে গেছে মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এতকার্যকরি অসহযোগ আন্দোলন কোথাও সাফল্য লাভ করেনি। পূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চলেছে দেশের সর্বত্র। লে. জেনারেল টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য পাওয়া গেল না হাইকোর্টের কোন বিচারপতি। পুলিশ এবং সিভিল সার্ভিসসহ গণ-প্রশাসনের বিভাগের কর্মচারিগণ কাজে যোগদান করতে অস্বীকার করেন। জনগণ সেনাবাহিনীর সরবরাও বন্ধ করে দিল। এমনকি সামরিক দপ্তরে অসামরিক কর্মচারিগণ তাদের অফিস বয়কট করলেন। কেবল কাজে যোগদান থেকেই বিরত থেকে ক্ষান্ত হলেন না, অসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের লোকেরাও সক্রিয় সমর্থন ও নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন শেখ সাহেবের প্রতি। তারা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন যে, আওয়ামীলীগ প্রশাসনের নির্দেশ ছাড়া তারা অন্য কারো নির্দেশ মেনে চলবেন না। এ অবস্থার মুখোমুখি হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন না হয়েও অসহযোগের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহনে অওয়ামীলীগ বাধ্য হলো। এ ব্যাপারে শুধু আপামর জনগণই নয়, বাংলাদেশের প্রশাসন ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দ্ব্যার্থহীন সমর্থণ তারা লাভ করেছিল। তারা অওয়ামীলীগের নির্দেশনাবলী সর্বন্তকরণে মাথা পেতে মেনে নিলেন এবং সমস্যাবলীর সমাধানে আওয়ামীলীগকে একমাত্র কর্তৃপক্ষ বলে গ্রহন করলেন। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ফাটল ধরলে দেখা দেয় নানাবিধ দুরূহ সমস্যা। কিন্তু এ সমস্যাবলির মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দপ্তরের কাজ যথারিীতি এগিয়ে চলছিলো। বাংলাদেশে কোন আইনানুগ কর্তৃপক্ষ না থাকা স্বত্তেও পুলিশের সহযোগিতায় আওয়ামীলীগ স্বেচ্ছাসেবকগণ আইনশৃঙ্খলা যে আদর্শ স্ঞাপন করেছিলেন, তা স্বাভাবিক সময়েও অন্যদের অনুকরণীয় হওয়া উচিত। আওয়ামীলীগ ও ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি জনগনের সর্বাধিক সমর্থন দৃষ্টে জেনারেল ইয়াহিয়া তার কৌশল পাল্টালেন। ৬ মার্চ ইয়াহিয়াকে একটা কনফ্রন্টেশনের জন্য উত্তেজনা সৃষ্টিতে র্দঢ় প্রতিজ্ঞ বলে মনে হলো। কেনানা তার ঐদিনের প্ররোচনামূলক বেতার বক্তৃতায় সংকটের সম্পূর্ণ দায়িত্ব চাপালেন আওয়ামীলীগের ওপর। অথচ যিনি ছিলেন সংকটের স্থপতি সেইই ভুট্টো সম্পর্কে একটি কথাও বললেন না। মনে হয় তিনি ধারনা করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তা নির্মূল করার জন্য ঢাকার সেনাবাহিনীকে করা হয় পূর্ণ সতর্কীকরণ।লে. জেনারেল ইয়াকুব খানের স্থলে পাঠানো হলো লে. জেনারেল টিক্কা খানকে। এই রদবদল থেকে প্রমান পাওয়া যায় সামরিক জান্তার ঘৃণ্য মনোভাবের পরিচয়। কিন্তু ইতোমধ্যে মুক্তিপাগল মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য পাগল হয়ে ওঠে। এ স্বত্তেও শেখ মুজিব রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অটল থাকেন। জাতীয় পরিষদে যোগদানের ব্যাপারে তিনি যে ৪ দফা প্রস্তাব পেশ করেন তাতে যেমন একদিকে প্রতিফলিত হয়েছে জনগণের ইচ্ছা, অপরদিকে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছানোর জন্য ইয়াহিয়াকে দেয় হয় তার শেষ সুযোগ। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটি অবশ্যই সুস্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে, শানিতপূর্ণ উপায়ে পাকিস্থানের রাজনৈতিক রাজনৈতিক সংকট নিরসনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ইয়াহিয়া এবং তার জেনারেলদের ছিল না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে সামরিক শক্তিকে জোরদার করার জন্য কালক্ষেপণ করা। ইয়াহিয়ার ঢাকা সফর ছিল আসলে বাংলাদেশে গণহত্র পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করা। এটা আজ পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে, অনুরূপ একটি সংকট সৃষ্টির পরিকল্পনা বেশ আগেভাগেই নেয়া হয়েছিল । ১ মার্চের ঘটনায় সামান্য কিছু আগে রংপুর থেকে সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়োজিত ট্যাংকগুলো ফেরত আনা হয়। ১ মার্চ থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্থানি কোটিপতি ব্যবসায়ি পরিবারসমূহের সাথে নোবাহিনীর লোকদের পরিবার পরিজনদের পাকিস্তানে পাঠানো হতে থাকে। ১ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশে সামরিক শক্তি গড়ে তোলার কাজ তরান্বিত করা হয় এবং তা ২৫ মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলে। সিংহলের পথে পিআইএ এর কমার্শিয়াল ফ্লাইটে সাদা পোষাকে সশস্ত্র বাহিনীর লোকদের বাংলাদেশে আনা হলো। সি-১৩০ পরিবহন বিমানগুলোর সাহায্যে অস্ত্র এবং রসদ এনে বাংলাদেশে স্তুপকৃত করা হয়। হিসাব নিয়ে জানােগেছে, ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জামসহ অতিরিক্ত এক ডিভিশণ সৈন্য বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। ব্যপারটা নিরাপদ করার জন্য ঢাকা বিমানবন্দরকে বিমানবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সমগ্র বিমানবন্দর এলাকায় অর্টিলারি ও মেশিনগানের জ্বাল বিস্তার করা হয়। যাত্রীদের আগমণ – নির্গমণের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়। ধ্বংসাত্নক কার্যকলাপ ও হত্যাকান্ড সংগঠনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত একদল এস,সি কমান্ড গ্রুপ বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ছেড়ে দেয়া হয়। ২৫ মার্চের পূর্ববর্তী দুই দিনে ঢাকা ও সৈয়দপুরে যে সব কূকান্ড ঘটে এরাই সবগুলো সংঘঠন করেছিল। সামরিক হস্তক্ষেপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্থানীয় ও অস্থানীয়দের মধ্যে সংর্ঘর্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে একটা উত্তেজনার পরিবেশ খাড়া করাই ছিল এ সবের উদ্দেশ্য। প্রতারণা বা ভন্ডামির এই স্ট্রটেজি গোপন করার অংশ হিসেবেই ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে তার আালোচনায় আপসমূলক মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন। ১৬ মার্চ আলোচনা শুরু হলে উয়াহিয়া তৎপূর্বে যা ঘটেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সমস্যার এটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার এক গুরুত্ত্বপূর্ণ পর্যায়ে ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আওয়ামীলীগের ক্ষমতা হস্তান্তরের ৪ দফা শর্তের প্রতি সামরিক জান্তার মনোভাব কি ? জবাবে ইয়াহিয়া জানান যে, এ ব্যপারে তাদের কোন আপত্তি নেই। তিনি আশা করেন যে, ৪ দফা শর্তপূরনের ভিত্তিতে উভয় পক্ষের উপদেষ্টাগণ একটা অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হবেন। আলোচনাকালে যেসব মৌলিক প্রশ্নে মতৈখ্য প্রতিষ্ঠিত হয় সেগুরো হলো :- ১। মার্শাল ল বা সামরিক আইন প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্টের একটি ঘোষণার মাধ্যমে একটা বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। ২। প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলসমূহের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। ৩। ইয়াহিয় প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবেন। ৪। জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যগণ পৃথক পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন । আজ ইয়াহিয়া ও ভুট্টো জাতীয় পরিষদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাবের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ইয়াহিয়া নিজেই ভুট্টোর মনোনয়নের জন্য এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ প্রস্তাবের সুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া সেদিন নিজেই বলেছিলেন যে, ৬ দফা হলো বাংলাদেশের এবং কেন্দ্রের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নির্ভর যোগ্য নীলনক্শা। পক্ষান্তরে এটার প্রয়োগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সৃষ্টি করবে নানারূপ অসুবিধা। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্থানি এমএনএ দের পৃথকভাবে বসে ৬ দফার ভিত্তিতে রচিত শাসনতন্ত্র এবং এক ইউনিট ব্যবস্থা বিলোপের আলেঅকে একটা নতুন ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে। শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার মধ্যকার এই নীতিগত মতক্যৈর পর একটি মাত্র প্রশ্ন থেকে যায় এবং তা হলো অন্তর্বর্তী পর্যায়ে কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্য ক্ষমদ্ বন্টন। এক্ষেত্রেও উভয় পক্ষ এই মর্মে একমত হয়েছিলেন যে,, ৬ দফার ভিত্তিত্বে অদুর ভবিষ্যতে যে শাসনতন্ত্র রচিত হতে যাচ্ছে মোটামুটি তার আালোকেই কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন হবে। অন্তর্বর্তীকালীন মীমাংসার এই সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা তৈরির উদ্দেশে প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জনাব এম, এম আহমেদকে বিমানে করে ঢাকা আনা হয়। আওয়ামীলীগ উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ-াারোচনায় তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, রাজনৈতিক মতক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৬ দফা কার্যকরী করার প্রশ্নে দূর্লভ কোন সমস্যা দেখা দেবে না। এমনকি অন্তর্বর্তী পর্যায়েও না। আওয়াশীলীগের খসড়ার ওপর তিনি যে তিটি সংশোধনী পেশ করেছিলেন তাতে এ কথাই প্রমানিত হয়েছিল যে, সরকার ও আওয়াশীলীগের মধ্যে যে ব্যবধানটুকু ছিল তা নীতিগত নয়, বরং কোথায় কোন শব্দ বসবে তা নিয়ে। ২৪ মার্চ বৈঠকে ভাষার সামান্য রদবদলসহ সংশোধণীগুলো আওয়াশীলীগ গ্রহণ করে। অতপর অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র চূড়ান্তকরণের উদ্দেশে্য ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের শেষ দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পথে আরকোন বাধাই ছির না। এ প্রসঙ্গে একটা জিনিষ পরিস্কার করে বলতে হয়, কোনো পরিস্থিতিতেই আলোচনার অচলাবস্থায় সম্মুখীন হয়নি। অথচ ইয়াহিয়া বা তার উপদেষ্টারা আভাস-ইঙ্গিতেও এমন কোনো কথা বলেননি যে, তাদের এমন একটা বক্তব্য আছে যা থেকে তারা নড়চড় করতে পারেন না। গণহত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত ছত্রছায়ার প্রশ্নেও আজ জোচ্চুরির আশ্রয় নিয়েছেন। আলোচনায় তিনি এবং তার দলবল একমত হয়েছিলেন যে, ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে যে ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল তিনিও সেভাবে একটা ঘোষণার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।ক্ষমতা হস্তান্তরের আইনগত ছত্রছায়ার ব্যপারে ভুট্টো পরবর্তীকালে যে ফ্যাঁকড়া তুলেছেন ইয়াহিয়া তা-ই অনুমোদন করেছেন। আশ্চর্যের ব্যপার, ইয়াহিয়া ঘুনাক্ষরেও মুজিবকে এ সম্পর্কে কেছু জানাননি। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জাতীয় পরিষদের একটা অধিবেশনে বসা দরকার ইয়াহিয়া যদি আভাস-ইঙ্গিতে এ কথা বলতেন তাহলে আওয়ামীলীগ নিশ্চয়ই তাতে আপত্তি করতো না। কেনানা এমন একটা সামান্য ব্যাপারকে উপেক্ষা করে আলোচনা বানচাল করতে দেয়া যায় না। তাছাড়া জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগুরু দল হিসেবে আওয়ামীলগের ভয় করার কিছুই ছিল না। দেশের দুই অংশের জাতীয পরিষদের সদস্যদের পৃথক পৃথক বৈঠকের যে প্রস্তাবে আওয়াশীলীগ সম্মতি দিয়েছিল, তা শুধু ভুট্টোকে খুশি করার জন্য করা হয়েছিল। এট কোন সময়ই আওয়ামীলগের মৌলিক নীতি ছিল না। ২৪ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া এবং আওয়ামীলীগ উপদেষ্টাদের মধ্যে চূড়ান্ত বৈঠকে জনাব এম,এম আহমেদ তার সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন। এই খসড়া প্রস্তাবের ব্যপারে চূড়ান্ত সিন্ধান্ত গ্রহনের জন্য জেনারেল পীরজাদার আহবানে এটা চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। দুঃখের বিষয় কোন চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং জনাব এম,এম আহমেদ আওয়ামীলগিকে না জানিয়ে ২৫ শে মার্চ করচি চলে গেলেন। ২৫ মার্চ রাত ১১ টা নাগাদ সম্সত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় এবং সেনাবাহিনী শহরে ‘পজিশন’ গ্রহন করতে থাকে। মধ্যরাত্রি নাগাদ ঢাকা শহরের শানিইপ্রয় জনগনের ওপর পরিচালনা করা হলো গণহত্যার এক পূর্ব নির্দিষ্ট কর্মসূচী। অনরূপ বিশ্বাসঘাতকতার নজির সমসাময়িক ইতহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।ইয়াহিয়া আওয়ামীলীগকে দেননি কোন চরমপত্র। অথবা মেশিনগান, অর্টিলারি সুসজ্জিত ট্যাঙ্কসূমহ যখন মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ও ধ্বংসলীলা শুরু করে দিল তার আগে জারি করা হয়নি ককোনো কারফিউ অর্ডার। পরদিন সকালে লে. জেনারেল টিক্কাখান তার প্রথম সামরিক নির্দেশ জারি করলেন বেতার মারফত। কিন্তু ৫০ হাজার লোক তার আগেই প্রাণ হাড়িয়েছেন বিনা প্রতিরোধ। এদর অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। ঢাকা শহর পরিণত হয় নরককুন্ডে, প্রতিটি অলিগলি ও অনাকানাচে চলতে লাগলো নির্বিচারেগুলি। সামরিক বাহিনীর লোকদের নির্বিচারে অগ্নিসংযোগের মুখে অন্ধকারে বিছানা ছেড়ে যেসব মানুষ বের হওয়ার চেষ্টা করলো তাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয় মেশিনগানের গুলিতে। আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখেও পুলিশ ও ইপিাআর বীরের মতো লড়ে গেল। কিন্তু দুর্বল, নিরীহ মানুষ কোনো প্রতিরোধ দিতে পারলো না। তারা মারা গেল হাজারে হাজারে। পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সেনাবাহিনী যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে আমরা তার একটা নির্ভরযোগ্য তালিকা প্রস্তুত করছি এবং তা শীঘ্রই তা প্রকাশ করব। মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে, সব বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার কাহিনি আমরা শুনেছি, এদের বর্বরতার ও নিষ্ঠুরতা তার সবকিছুকে ম্লান করে দিয়েছে। পকিস্তান সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে তিনি তাদের দিয়ে গেলেন বঙালি হত্যার এক অবাধ লাইসেন্স। কেন তিনি এই বর্বরতার আশ্রয় নিয়েছিলেন, পরদিন রাত ৮ টার সময় বিশ্ববাসীকে জানানো হলো এর কৈফিয়ত। এই বিবৃতিতে তিনি নরমেধযজ্ঞ সংগঠনের একটা ব্যাখ্যা বিশ্ববাসীকে জানালে?

সম্পর্কিত সংবাদ

শাহজাদপুরের সাবেক এমপি কবিতা ও চয়নের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা

রাজনীতি

শাহজাদপুরের সাবেক এমপি কবিতা ও চয়নের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর আসনের সাবেক দুই সংসদ সদস্যসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে। ঘটনার দুই বছর পর বৃহস্পতিব...

নানা অব্যবস্থাপণায় চলছে পাবনা সেচ প্রকল্প

নানা অব্যবস্থাপণায় চলছে পাবনা সেচ প্রকল্প

পাবনা প্রতিনিধি :-নানা অব্যবস্থাপণার মধ্যদিয়ে চালু রয়েছে পবনা সেচ প্রকল্প। অবহেলা ও অনিয়মের কারণে সেচ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ...

শাহজাদপুরে ওয়াজ শুনে বাড়ি ফেরার পথে সড়কে প্রাণ গেল শিশু হোসাইনের

শাহজাদপুর

শাহজাদপুরে ওয়াজ শুনে বাড়ি ফেরার পথে সড়কে প্রাণ গেল শিশু হোসাইনের

ওয়াজ শুনে বাড়ি ফেরার পথে মহাসড়ক পাড়ি দেয়ার সময় পাবনা থেকে ঢাকাগামী একটি মাইক্রোবাস চাপায় হোসাইন সরদার নামের এক ৯ বছরের শ...