শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
04 -আবুল বাশার- ‘আমি চির বিদ্রোহী বীর/বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!’ ‘বিদ্র্রোহী’ কবিতার সেই অমর পঙক্তিতে বাঙালি এবং নিজের আত্মপরিচয়কে এভাবেই তুলে ধরেছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মানবতা, প্রেম, দ্রোহ, চেতনার কবি তিনি। নিজের ক্ষুরধার লেখনীর আঁচড়ে স্থান করে নিয়েছেন বিশ্বসাহিত্যে। গদ্য, পদ্য, উপন্যাস, সঙ্গীত- সব শাখায় তার আগমন ছিল ধূমকেতুর মতো। বাংলা সাহিত্যে তার আগমন প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের এক গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন ‘আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’ আজ সেই বিদ্রোহী কবি জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ১১৭ তম জন্মদিবস একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কবির বৃহৎ সাহিত্য কর্মের ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে প্রবন্ধ লিখে আলোচনা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি- পাঠক ও শ্রোতাদের প্রতি রইলো আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা । কবির জন্মকথা- আজ ২০১৬ সালের ২৫ মে (১৪২৩ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ্য) সাম্য-মানবতা ও প্রেমের কবি, বিদ্রোহী কবি, মুসলিম বাংলার জাগরণের কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৭ তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৯৯ সালের ২৫ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া প্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি নজরুল। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েও তিনি কখনও আপস করেননি লোভ-লালসা, খ্যাতি, অর্থ-বিত্ত ও বৈভবের কাছে। শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমন্ডকতার বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। ভালোবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ ইত্যাদি বিষয় তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক। নজরুলের পুরো জীবনটাই বিচিত্র ও বর্ণিল- কাজী নজরুল ইসলাম ব্যতিক্রমধর্মী ছিলেন বাল্যকাল থেকে। ৮ বছর বয়সে পিতৃ বিয়োগের পর জীবনের কঠিন রূপ তিনি দেখেছেন। কিন্তু প্রতিভা দমিয়ে রাখতে পারেনি এই আর্থিক দরিদ্রতা। কবির ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। জীবিকার তাগিদে রুটির দোকানে কাজ করা থেকে শুরু করে মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবেও কাজ করেছেন। মূলত লেটো দলে যোগদানের মাধ্যমেই সাহিত্যচর্চা অঙ্কুরিত হয়। এ দলের বিভিন্ন নাটকের জন্য তিনি গান ও কবিতা লেখেন। নজরুলের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় মক্তবে। দারিদ্র্যের কারণে মাত্র দশ বছর বয়সেই পরিবারের ভার বহন করতে হয়েছে তাকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতাকে। সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা রাখেন। সক্রিয় রাজনীতি করার কারণে বারবার তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে। কারাবন্দি থাকা অবস্থায় তিনি রচনা করেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। বন্দিদশার ভেতর দিয়ে তার হাতে সৃষ্টি হয়েছে গান, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, ছোট গল্পসহ অসংখ্য রচনা। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে কুমিল্লা থেকে ফেরার পথে কাজী নজরুল ইসসলাম দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি করেন। একটি হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও অপরটি ‘ভাঙ্গার গান’। এই দুই সাহিত্যকর্ম বাংলা পদ্য ও গণসঙ্গীতের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল তখন। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমে বাংলাকাব্য জগতে নতুন দিনের সূচনা হয়। এ কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহী কামাল পাশা’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’সহ প্রত্যেকটি কবিতাই বাংলা কাব্যে নতুন বাঁক সৃষ্টি করেছিল। সঙ্গীত রচনায় নজরুল অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি প্রায় তিন হাজার গান রচনা ও সুর করেছেন। রাগ-রাগিণীকে দারুণভাবে খেলিয়েছেন গানে গানে। ছোটগল্প, উপন্যাস, সঙ্গীত, নাটক লিখলেও মূলত কবি হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। আজীবন বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠের কারণে তিনি ভূষিত হন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। জীবনের মধ্যপথে তেজদ্দীপ্ত কবি অকস্মাৎ নির্বাক হয়ে যান। চিরতরে মূক হয়ে পড়েন গানের পাখি। সময়টা ১৯৪২ সালের শেষার্ধ। ১৯৭২ সালের ২৪ মে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। তাকে দেয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা। বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি. লিট উপাধি প্রদান করে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি একুশে পদকে ভূষিত করা হয় কবিকে। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। ৭৭ বছর বয়সে সেখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট (১২ ভাদ্র) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কবি মত্যুর ১২ বছর আগে লিখেছিলেন অমর পঙ্কক্তি : ‘মসজিদেরই পাশে আমায় করর দিও ভাই, যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’। তার সে ইচ্ছানুযায়ী কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। জীবদ্দশায় নজরুল হয়ে উঠেছিলেন গোটা ভারত উপমহাদেশের মানুষের মুক্তি ও চেতনার কবি। বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলে, শোষকের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে শক্তিমান লেখনীর মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ গড়ে জেল খেটেছেন একাধিকার। নজরুল বিদ্রোহ করেছেন সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে। বলেছেন ‘চির উন্নত মম শির’। কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। কবি নজরুল ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত লিখেছেন দু’হাতে। তার স্বল্প পরিসর সাহিত্য জীবনে লিখেছেন অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সঙ্গীত, নাটক-নাটিকা, কিশোর কাব্য, কাব্যানুবাদ, কিশোর নাটিকা প্রভৃতি। তিনি রচনা করেছেন চার হাজারেরও অধিক গান, যা নজরুল সঙ্গীত পরিচিত। তার গান ছাড়া এখন যেন ঈদের আনন্দই পূর্ণতা পায় না। তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না... Kabi Nazrulকবি নজরুল আমাদের মাঝ থেকে চির বিদায় নিয়ে চলে গেছেনে পরপারে, না ফেরার দেশে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে তিনি কি চলে গেছেন ? না যাননি। তিনি বলে গেছেন “তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,/ কোলাহল করি সারা দিনমান কারও ধ্যান ভাঙিব না।/ নিশ্চল নিশ্চুপ/ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ...। তিান আলো বলে গেছেন, ‘বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম...। এভাবে সব বলে কয়েই যেন বিদায় নিয়েছিলেন চির অভিমানী কবি। বিপুল কর্মযজ্ঞ শেষে বিদ্রোহী বীর সাম্য প্রেম মানবতার কবি কান্ডারীকে থামতে হয়েছিল। তবে আজকের জন্মদিনে কবির একান্ত চাওয়াটির কথা মনে রাখা চাই, যেখানে কবি বলেছেন, যেদিন আমি চলে যাব সেদিন হয়তবা বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে, দেশপ্রেমিক-ত্যাগী-বীর-বিদ্রোহী বিশ্লেনের পর বিশ্লেষণ, টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পড় মেরে, বক্তার পর বক্তা এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে-বন্ধু তুমি যেন যেওনা। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো, তোমার ঘরের আঙ্গিনায় বা আশেপাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি...। আজ জন্মদিনেও আমরা শ্রদ্ধাভওে হৃদয়ের অনুভ’তি দিয়ে কবির বাক্যগুলো স্মরণ করবো । আজ কবির জন্মদিনে নানা আয়োজনে সারাদেশে দিবসটি পালিত হবে। কথা গান কবিতায় প্রিয় কবিকে অঞ্জলি জানাবেন দুই বাংলার ভক্ত অনুরাগীরা। আমরাও এর বাইরে নই। আমরা শাহজাদপুরেও যথাযোগ্য মর্যাদায় কবির জন্মজয়ন্তীী পালন করছি শ্রদ্ধাভরে কবিকে স্মরণ করতে। ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি’-- তার এক হাতে ছিল ‘বাঁকা বাঁশের বাঁশরী/ আর হাতে রণ-তূর্য।’ বিশ্ব মানবতার জয়গানে তার কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ ভূ-লোক, দ্যুলোক, গোলক ভেদিয়া/ খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’- ওঠার সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন। দ্রোহে ও প্রেমে, কোমলে-কঠোরে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে খুলে দিয়েছেন বিস্ময়কর নতুন দিগন্ত। প্রেম দ্রোহ সাম্য মানবতার মহাকবি তিনি। তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সেই বিস্ময়কর এই তূর্যবাদকের জন্মবার্ষিকী আজ। ‘চির বিদ্রোহী বীর’, ‘চির উন্নত শির’-এর কবি মাথা নত করেননি লোভ-লালসা, খ্যাতি, অর্থ, বিত্ত-বৈভবের কাছে। মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার পক্ষে কলম ধরেছেন নির্ভীক চিত্তে। ধূমকেতুর মতো উদয় হয়েছিলেন তিনি বাংলা সাহিত্য গগনে। মানবতার জয়গানে তিনি ছিলেন অভাবনীয় কণ্ঠ। লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্...’। তার রচিত ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি আমাদের রণসঙ্গীত। জাতীয় জাগরণের রূপকার নজরুল বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমোজ্জ্বল প্রতিভা- নজরুল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নতুন যুগ¯্রষ্টা। বিস্ময়কর এক আলো হয়ে জ্বলছেন। পথ দেখিয়ে চলেছেন বাঙালীকে। জাত চেনাতে কবি নিজেই লিখেছিলেন,‘আমি চির বিদ্রোহী বীর/ বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!’ তবে শুধু বিদ্রোহী বীর নন, তিনি ছিলেন ‘বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের।’ ‘অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা’ নিজের মধ্যে ধারণ করেছিলেন। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষের নাম কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভান্ডারটির ¯্রষ্টা তিনি। অসাম্প্রদায়িক এই কবি বাঙালীর চিন্তা-মনন ও অনুভূতির জগতে নানাভাবে নাড়া দিয়েছেন। অন্যান্য সৃষ্টির পাশাপাশি তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নজরুলকে ভিন্ন উচ্চতায় আসীন করে। এ কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন কবি। মানবতার বাণী প্রচার করেন। কাছাকাছি সময়ে রচিত তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা’। এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস- চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো কবিতা সংকলন ‘অগ্নিবীণা’। এই কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আরও কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থেও ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো দারুণ হৈচৈ ফেলে দেয় সে সময়। গদ্য রচনার সময়ও স্বতন্ত্র চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েছেন নজরুল। তাঁর প্রথম গদ্য রচনা ‘বাউলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচী সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখান থেকেই তাঁর সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। এখানে বসেই তিনি লিখেছেন ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সংকলন ‘ব্যথার দান’। একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সংকলন ‘যুগবাণী’। তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুনুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে আছে সঙ্গীত। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তাঁর সৃষ্ট রাগ বিস্মিত করে বড় বড় পন্ডিতের। কাজী নজরুল ইসলাম নিজের সকল সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের কথা বলেছেন। মানবতার কথা বলেছেন। সাম্যের কবি নারীর প্রতি উপেক্ষা কখনও মেনে নেননি। সমাজের নীচু শ্রেণীর মানুষকে কাছে টেনে নিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক, কালপ্রবাহের, সমগ্র মানব জাতির কবি নজরুল- কবি নজরুল কোন বিশেষ দল কিংবা সমাজের ছিলেন, তা নয়। কোন দেশ, কাল ও জাতির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। সকল কালের মানুষের গীতে মুখর তাঁর কাব্য। বাঙালীর চিরকালের চেতনাকে সমুন্নত করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকল কালের, সকল জাতির কবি। বনের কুসুমের মতো, আকাশের পাখির মতো আপনি ফুটে উঠেছেন আপন স্বভাবে। আপনি গান গেয়েছেন মুক্তকণ্ঠে, আপন খেয়ালে। আর সে কারণেই হয়ে উঠেছেন সর্বদলীয় কবি। শুধু মুসলমান বা শুধু হিন্দুর কবি ছিলেন না, ছিলেন সকল ধর্মের, সকল গোত্রের সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার স্মারক। নিজেই বলেছেন,‘ রাজবন্দীর জবানবন্দী’তে যে,‘‘ আমার কণ্ঠে প্রলয় হুংকার একা আমার নয়, সে নিখিল আর্ত-পীড়িত আত্মার যন্ত্রণার চিৎকার।’’ আবার এমনটাও বলেছেন, ‘ আমি লীগ কংগ্রেস কিছুই মানি না, মানি শুধু সত্যকে; মানি সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বকে, মানি সর্বজনগণের মুক্তিকে।’ তাই দেখি ‘ বিদ্রোহী’র যে ‘আমি’ সেতো ‘বিশ্ব আমি’, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী। সারা বিশ্বের উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল থামানোর জন্যই আজীবন সংগ্রামমুখর ছিলেন। জগতের অনশনবন্দী, লাঞ্ছিত জনগণের ঘুম ভাঙ্গাতে আশা-অনুপ্রেরণায় বিশ্ববাসীকে উদ্দীপ্ত করতেই যেন তাঁর আবির্ভাব। গেয়েছেন সাম্যের গান। বুঝেছেন, মানুষের চেয়ে নয় কিছু গরীয়ান। লিখেছেনও তাই, ‘দীন দরিদ্র রবে না কেউ সমান হবে সর্বজন/ বিশ্ব হবে মহাভারত নিত্যপ্রেমের বৃন্দাবন।’ ধার্মিক মুসলিম সমাজ ও অবহেলিত জনগণের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা করেছেন তীব্র ভাষায়। ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী এই কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কারণে অসংখ্যবার জেল খেটেছেন। জেলে বসেই তিনি লিখেছেন বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এভাবেই দুর্দম গতিতে এগিয়ে চলেছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন আজকের নজরুল। অথচ এই ক্ষণজন্মা মানুষটির জীবনের শুরুটা ছিল ভীষণ অনিশ্চয়তার। কবি নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক বিশ্বাস-- নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক বিশ্বাস নির্দিষ্ট করে কি ছিল বলা মুশকিল। ১৯২০-এ কলকাতায় ফিরে আসার পর প্রথম দিকে তখন তিনি খেলাফত আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। স্বল্পকালের মধ্যে তার আকর্ষণ সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের প্রতি ধাবিত হয় তাদের সশস্ত্র কর্মকান্ডের মধ্যে নজরুল তার লালিত আদর্শের প্রতিরূপ দেখতে পেয়েছিলেন। জীবনের এই পর্যায় অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাকে মহাত্মা গান্ধীর স্বরাজ আদর্শের অনুসারী হতে দেখি। আবার অনতিবিলম্বে গান্ধী রাজনীতির প্রতি তার যাবতীয় শ্রদ্ধাবোধ অবসিত হয়ে আসে। অতঃপর তার রাজনৈতিক আদর্শ একান্তভাবেই ‘সাম্যবাদ’। কমরেড মুজফফর আহমদ প্রমুখের সঙ্গে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। সাম্যবাদী আদর্শের সঙ্গে তার মনের অনেকখানি মিল হয়েছিল। নজরুল সাহিত্যে গণমানবের মুক্তির উগ্র যে আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে, সাম্যবাদী আদর্শের প্রতি অনুরাগ না জন্মালে সেটা সম্ভব হতো না। কিন্তু এই মিলের পেছনে যতটা সামাজিক উপযোগিতা ছিল, ততটা সূক্ষ্ম চিন্তাভাবনার সমর্থন ছিল না। শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকা নজরুলের পক্ষে সম্ভব হয়নি। একেবারে শেষপর্যায়ে দেখি তিনি নির্বাচনে কংগ্রেস পার্টির প্রার্থী হয়েছেন। আসলে নজরুলের সুচিন্তিত তেমন কোনো রাজনৈতিক মতামত ছিল বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে সর্বদাই তিনি অন্তরের অপরিমের আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। তবে বাঙালি সমাজ সম্বন্ধে নজরুলের দু’ধরনের স্থির বিশ্বাস ছিল। তিনি হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি এবং ঐক্যে পুরোপুরি বিশ্বাসী ছিলেন। আর মুসলমান সমাজের একেবারে ভেতর থেকে একটা ব্যাপক জাগরণ, একটা প্রাণতরঙ্গ সৃষ্টি করে এই জড় সমাজটির মধ্যে একটা জঙ্গমতা সঞ্চার করার জন্য তিনি সদা তৎপর ছিলেন। নজরুলের ‘জয় বাংলা’--- পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, সুরমা-ধলেশ্বরী-কর্ণফুলী, আরও কত শত নদ-নদীবাহিত, পলিগঠিত এই বঙ্গীয় অববাহিকা। অনাদিকাল থেকে এই ব-দ্বীপ ভূমিতে বিবর্তমান মানবগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্র্যসূচক অভিধার নাম বাঙালী। আর তার বসতভূমির নাম বাংলা নামের দেশ। ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবী ধারাবাহিকতায় পূর্ব দৃষ্টান্তরহিত এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম-জাতিরাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়ার মুহূর্তে তার সাংবিধানিক নাম হলো ‘বাংলাদেশ’। এ কারণে এই রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের কাছে ‘নদী বা বদ্বীপ বা পলির মতো অনিবার্য ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক উপাদানের মতোই ‘বং, বাংলা বা বাঙালী’ শীর্ষক শব্দত্রয়ীও তার সত্তার পরিচয় নির্ণয়ে বিকল্পরহিত ব্যক্তিক ও সামষ্টিক অভিধা। আসলে হাজার বছরের বিবর্তনের ধারায় বাঙালী এই অভিধা স্বতঃপ্রাকৃতিকভাবেই অর্জন করেছে। এই অভিধা যেমন তার আপন অর্জন, তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক-নৃতাত্ত্বিক বিবর্তনের পথও প্রায় স্বতঃসিদ্ধতাজাত। তাই এই জাতিরাষ্ট্র ও তার নাগরিকের সার্বিক বিজয় মানে বাংলা ও বাঙালীর বিজয়। ইতিহাসপূর্ব কাল থেকে এই সত্যটি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে অনুধাবন করেছেন বাংলার লোককবি, লোকদার্শনিক ও ভাবুক সম্প্রদায়। আর তারই প্রকাশ দেখি ইতিহাসস্বীকৃত যুগে বাঙালী কবির মৌখিক ও লিখিত অভিব্যক্তিতে। বাংলা ভাষার প্রথম লিখিত দলিল ‘চর্যাপদে’র কবি ভুসুকর কণ্ঠে উচ্চারিত হলো ‘বাঙালী’ অভিধাটি (‘আজি ভুসুকু বঙালি ভইলি’)। মধ্যযুগের কবি শ্রীধর দাসের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, তার মাতৃভাষার নাম বাংলা, যদিও তার সাহিত্যচর্চার মাধ্যম ছিল সংস্কৃত। কেননা সমাজ তখন তাঁকে অন্য ভাষায় সাহিত্যচর্চার অধিকার দেয়নি। অথচ তিনিও তাঁর মাতৃভাষা বাংলাকে গঙ্গাজলের মতোই পবিত্র মনে করেছেন। পাশাপাশি স্মরণযোগ্য মধ্যযুগের মুসলমান কবি আবদুল হাকিমের কণ্ঠে উচ্চারিত মাতৃভাষার সপক্ষে তীব্র শ্লেষাত্মক উক্তি, ‘যে জন বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’। তার পর থেকে বাংলা ও বাঙালিত্বের এই ধারণা, প্রেরণা, শক্তিমত্তা ও বহুমাত্রিকতা বাঙালী কবির চিত্তে কত বিচিত্র পথে সংজ্ঞায়িত হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। এই বিষয়ে একটি অনুপুঙ্খ গবেষণা হলেই কেবল এর ব্যাপ্তি উপলব্ধি করা যাবে। চর্যা-কবি, মঙ্গল-কবি, পুঁথি-কবি, বৈষ্ণব-কবি বা বাউল-কবির পরম্পরা পেরিয়ে পাশ্চাত্য মনন-দর্শনে সমৃদ্ধ হয়ে বিশ্বভিখারি ও আধুনিক হওয়ার মুহূর্তেও আধুনিক বাঙালী কবিরা অভ্রান্তভাবে বাংলা নামক দেশ ও বাংলা নামক ভাষার অনিবার্যতার জয়গান করেছেন। মাইকেলের মাতৃভাষা বন্দনা বাঙালীর বোধ ও বিবর্তনের ইতিহাসে এ রকমই এক নির্ণায়ক ঘটনা। আসলে এই হচ্ছে ইতিহাসের সেই কাব্যসম্মত রায়, যা অদ্যাবধি বাঙালী কবি, সারস্বত সমাজ ও বাংলার সর্বশ্রেণীর লোক-মানুষকে সর্বাংশে মাতৃভাষী তথা বাংলাভাষী করে রেখেছে। তা না হলে বাংলাদেশ, বাঙালী জাতি ও বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্নতর মানসিকতার দাসত্ব বাঙালীকে স্ব-সত্তা থেকে বিযুক্ত করে ঔপনিবেশিকতার স্বর্ণশিকলে চিরপরাধীন করে রাখত। আসলে বাঙালী কবির কাছে বাঙালী ও বাংলার জয়গান মানে তার শনাক্তকৃত স্ব-সত্তার স্বাধীনতার গান। এই পথেই বাঙালী এগিয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার গন্তব্যে। বঙ্গভঙ্গের আশঙ্কায় ব্যথিত কবিচিত্ত তাই বাউল বাঙালীর সুরে ও উক্তিতে বিশ শতকের শুরুতেই জয়গান করলেন অষন্ড বাংলার রূপৈশ্বর্যের : ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। সঙ্গে সঙ্গে তাই হয়ে গেল ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-মত-পথ নির্বিশেষে বাঙালীর জাতীয় উচ্চারণ, যার সর্বজনীন স্বীকৃতি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। আর এই বোধ-বিবর্তনের পথে বাঙালী কবির কণ্ঠে বিজয়সূচক ব্রহ্মধ্বনি : ‘জয় বাংলা’। এটি উচ্চারিত হয়েছে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরুতে, যখন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতাটি লিখলেন। কবিতাটি ১৯২৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ভাঙার গান’ শীর্ষক গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, ১৩৩১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ (১৯২৪ সালের আগস্ট) মাসে প্রকাশিত হওয়ার মাস তিনেকের মধ্যে অর্থাৎ ১১ নবেম্বর তারিখে বইটি ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। তারপর থেকে এই বইয়ের ওপর এই নিষেধাজ্ঞাটি আর প্রত্যাহার করা হয়নি। এই গ্রন্থের প্রথম কবিতার প্রথম পঙক্তি, ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট/ ভেঙে ফেল কররে রে লোপাট/ রক্ত-জমাট/ শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদী!/’। মাত্র এগারোটি কবিতা নিয়ে সঙ্কলিত এই ব্রিটিশত্রাসী কাব্যগ্রন্থের চতুর্থ কবিতা ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’। অগ্নিযুগের অগ্নিপুরুষ মাদারীপুরের শান্তি সেনাবাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত পূর্ণচন্দ্র দাস মহাশয়ের কারামুক্তি উপলক্ষে নজরুল এই কবিতাটি রচনা করেন। কবিতাটি তিনি সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি করেন এবং হারমোনিয়াম সহকারে গেয়ে শোনান। ছয় পঙ্কক্তির নয়টি স্তবকে সজ্জিত (মোট পঙ্কক্তি ৫৪) এই দীর্ঘ কবিতাটি নজরুল তাঁর স্বভাবসুলভ মাত্রা মাত্রাবৃত্তের ধ্বনি ঝঙ্কারে সংগ্রথিত করেছেন। প্রতিটি পঙ্কক্তিতে ছয় মাত্রার তিনটি পর্ব ও তারপর একটি অপূর্ণ পর্ব। এই বিন্যাস একটি সুসজ্জিত সৈন্যদলের শৃঙ্খলাপরায়ণ মার্চপাস্টের ভঙ্গি ও বীর্যবত্তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই কবিতার সুশৃঙ্খল চরণে-স্তবকে বাংলার ইতিহাস, পুরাণ, কিংবদন্তির পাশাপাশি বাঙালীর ভবিষ্যত মুক্তিযুদ্ধ ও অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের বার্তা আভাসিত হয়ে আছে। আশ্চর্যজনকভাবে এই কবিতার ৫১ ও ৫২ পঙ্কক্তি নিম্নরূপ : ‘জননীর যবে মিলিবে আদেশ, মুক্ত সেনানী দিবে হুকুম/ শত্রু-খড়গছিন্ন-মুন্ড- দানিবে ও-পায়ে প্রণাম-চুম’। তারপরেই এক অবিসংবাদিত নেতার প্রতি কবির স্বাগতিক উচ্চারণ : ‘স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারীপুরের মর্দবীর,/ বাংলা মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!’ জননীর আদেশ পেলেই মুক্ত সেনানী হুকুম দেবেন যুদ্ধের এবং সেই ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধে শত্রুর ছিন্ন মস্তক লুটাবে জননীর পায়ের তলায়। এখানে সম্ভাব্য হুকুমদাতা মাদারীপুর তথা ফরিদপুরনিবাসী এক বিপ্লবী, যিনি সদ্য কারামুক্ত। কী আশ্চর্য, তার মাত্র ৪৭ (১৯৭১-১৯২৪=৪৭) বছর পর সর্বযুগের আরেক শ্রেষ্ঠ বাঙালী বিপ্লবী ‘জননীর আদেশ পেয়ে’ অর্থাৎ ‘নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে’ ঘোষণা করছেন বাংলার পূর্ণাঙ্গ ‘স্বাধীনতা’ আর হুকুম দিচ্ছেন সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের (৭ মার্চ, ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু, ফরিদপুরবাসী)। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকাব্যেও ‘স্বাধীনতা’, ‘হুকুম’ ও ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিগুচ্ছ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে। আর এ-ও লক্ষ্য করার বিষয় যে, কবিতাটির ২৭নং পঙক্তির শুরুতেই ‘জয় বাঙলা’ ধ্বনি বাংলা ভাষায় প্রথম উচ্চারিত : ‘জয় বাঙলা-র পূর্ণচন্দ্র্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ’। ২৮নং পঙক্তি : ‘জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন’। এই জোড়া পঙক্তিতে (২৭-২৮) ‘জয়’ ধ্বনিটি ঘূর্ণিছন্দে পাঁচবার উচ্চারিত হয়েছে এবং নজরুলের আরেকটি সমূহ গুরুত্বপূর্ণ গদ্যে (‘বাঙালির বাঙলা’) একই আবহে বার বার প্রযুক্ত হয়েছে। ‘যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি’ বলার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণচন্দ্র মহাশয়ের পর ভবিষ্যত নেতা-সেনানীদের প্রতিও এই আহ্বান সম্প্রসারিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেই ঐতিহ্যিক ধারারই শ্রেষ্ঠ ও চূড়ান্ত নেতা-সেনানী; আর তাঁর কণ্ঠেই পুনরুচ্চারিত সেই বিজয়-ধ্বনি : ‘জয় বাংলা’। ১৯৪২ সালে রচিত ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধে নজরুল লিখেছেন, ‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও : এই পবিত্র বাংলাদেশ/ বাঙালির-আমাদের।/ দিয়া প্রহারেণ ধনঞ্জয়/ তাড়াব আমরা করি না ভয়/ যত পরদেশী দস্যু ডাকাত/ রামা-দের গামা-দের’। বাঙলা বাঙালির হোক। বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক।’ কাজেই ‘জয় বাংলা’ শীর্ষক বাঙালীর চিরকালীন জয়ধ্বনির উৎস নজরুলের চিরদ্রোহী কবিচিত্ত। তাঁর প্রথম উচ্চারণও যে নজরুলেরই চিরমুক্ত কবিকণ্ঠ, তা আজ তর্কাতীত। নজরুলের ‘বিদ্রোহী আত্মা ও স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার’ সুস্পষ্ট শনাক্তকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সচেতনভাবেই নজরুলের কাছ থেকে এই ব্রহ্মধ্বনি গ্রহণ করে সকল কালের সকল বাঙালীর জন্য পুনরায় উন্মুুক্ত করেছেন। নজরুল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন এখানে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, ‘নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালীর স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার। ... পরাধীন জাতির তিমিরঘন অন্ধকারে বিশ্ববিধাতা নজরুলকে এক স্বতন্ত্র ছাঁচে গড়ে পাঠিয়েছিলেন এই ধরার ধুলায়।’ কাজেই নজরুল ও বঙ্গবন্ধু উক্তিতে ও উপলব্ধিতে অভিন্ন। একজন বিদ্রোহের উচ্চারক ও পরিকল্পক, অন্যজন তার ধারক ও বাস্তবায়ক। বাঙালীর পরিশ্রুত প্রতিকৃতির নাম নজরুল আর বাঙালীর শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা বিশ্বাস করি, এই বিষয়টি বক্ষ্যমাণ কবিতার টেক্সট বিশ্লেষণ করে আরও পূর্ণতা দেয়া আবশ্যক। বিষয়টি সামাজিক ও নান্দনিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। যা হোক, বাঙালীর এই বিদ্রোহী সত্তা ও বিজয়ী চেতনার ধারাবাহিকতার আলোকে একালের কবির প্রতিধ্বনি : ‘নজরুলের সেই ‘জয় বাংলা’ কণ্ঠে নিল বাংলার গুপ্রকৃতি, বিলঝিল, শঙ্খচিল, ধরিত্রী উদগ্রীব.../নজরুলের সেই ‘জয় বাংলা’ কণ্ঠে নিল বাঙালীর জাতিপিতা শেখ মুজিব।/সেই থেকে এই ধ্বনি অনন্তপ্রবাহিনী।/ সেই থেকে এই ধ্বনি বাঙালির বিপদনাশিনী।/সেই থেকে এই ধ্বনি জনগণমন গিরিতটমন সাগর-নদীর।/সেই থেকে ‘বল বীর বল চির-উন্নত-মম শির’।/বিদ্রোহী বাঙালী ও বিজয়ী বাঙালীর এই জয়ধ্বনি ক্রমপ্রসারমান বিশ্ববাঙালীর বুকে-মুখে হয়ে উঠুক এক অসাম্প্রদায়িক ও অভিন্ন উচ্চারণ। নজরুলের কাছে আমাদের ঋণ বাংলা কাব্যগগনে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব নানা কারণেই একটা যুগান্তকারী ঘটনা। একজন সাহিত্য¯্রষ্টার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার তার ভাষা। ভাষার মধ্যেই তার প্রাতিস্বিকতার অনেকখানি নিহিত। একজন লেখক বা কবি যে ভাষারীতিটি প্রকাশমাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন তাতেই তার সবটুকু পরিচয় ফুটে ওঠে। সাহিত্যের প্রাণবস্তুর মধ্যে নতুন কোনো উপাদান যুক্ত হলে ভাষা ব্যবহারের ভঙ্গিতে অবশ্যই তার ছাপ পড়বে। সাহিত্যের প্রাণ এবং প্রকাশরীতি এ দুটো কোনো আলাদা ব্যাপার নয়। ‘পুরনো বোতলে নতুন মদ’ পরিবেশন করার প্রচলিত প্রবাদটি সাহিত্যের বেলাতে কোনো অর্থই বহন করে না। নতুন সাহিত্যের নতুন প্রকাশরীতি চাই, নইলে নতুনকে চেনার উপায় থাকে না। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষায় প্রচলিত পয়ার-ত্রিপদী এসব ছন্দ তার প্রতিভার প্রকাশমাধ্যম হওয়ার অযোগ্য বিবেচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার মধ্যে এনেছিলেন দ্যুতি। রবীন্দ্রনাথ বাংলাকে বহুমাত্রিক প্রকাশভঙ্গির বাহন করার যোগ্য মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা দান করেন। ভাষার মধ্যে স্বাধীন চিত্তবৃত্তির সাবলীল স্ফূর্তির যে ক্ষেত্র রবীন্দ্রনাথ তৈরি করলেন সেই বিষয়টা স্মরণে না রাখলে বাংলা ভাষায় কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব পূর্বাপর সম্পর্করহিত একটা খাপছাড়া ঘটনা মনে হবে। বাংলা কাব্যগগনে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব নানা কারণেই একটা যুগান্তকারী ঘটনা। বাংলা কবিতার বিকাশধারায় নজরুল একটা চমৎকার ক্যাটালিস্ট বা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন, সে বিষয়ে সাহিত্য-সমালোচকদের অনেকেই একমত। তার সাধনার সিদ্ধির ব্যাপারে মতান্তর থাকতে পারে, কিন্তু শক্তি সম্বন্ধে মতদ্বৈধতার অবকাশ অল্পই আছে। সমস্ত সীমাবদ্ধতা, অসম্পূর্ণতা এবং অসঙ্গতি সত্ত্বেও কবি হিসেবে, মানুষ হিসেবে, যুগনায়ক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই একজন অনন্য পুরুষ। এই অনন্যতার একটি পরিচয় তিনি কবিতা, গান, এমনকি গদ্য রচনায়ও যে ভাষারীতিটি ব্যবহার করেছেন, তার মধ্যে মূর্ত করে তুলেছেন। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে নজরুলের ব্যবহৃত ভাষারীতিটির একটি ঐতিহাসিক-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত আবিষ্কারের চেষ্টা করা হয়েছে। নজরুলের কাছে বাঙালি মুসলমান সমাজের অন্যতম প্রধান প্রণিধানযোগ্য ঋণ এই যে, নজরুল তাদের ‘ভাষাহীন পরিচয় ঘুচিয়ে দিয়ে তাদের সামাজিক ভাষাকে সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দান করলেন এবং স্বীকৃতি অর্জন করে দিলেন। আর নজরুলের কাছে সমগ্র বাঙালি সমাজের ঋণ এই যে, নজরুল বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যকে বাঙলার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করে নব বিকাশধারায় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে অনেক দূর পযন্ত গাঁথুনি নির্মাণ করেছিলেন।আমরা জানি, নজরুলের চিন্তা ভাবনার মধ্যে নানা রকম সীমাবদ্ধতা ছিল। আর তার সাধ এবং সাধ্যের মধ্যে পার্থক্যও ছিল বিরাট। নতুন কোনো মৌলিক চিন্তা তিনি সমাজের কাছে হাজিরও করতে পারেননি। কিন্তু চিত্তের এমন একটি আবেগ, এমন একটি সহজ সরল কান্ডজ্ঞান তিনি বাঙালি মুসলমান সমাজে চাপিয়ে দিতে পেরেছিলেন, তার প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী হয়েছে। তার সাধনার মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজ সংস্কৃতি-চর্চার একটি নতুন দিগন্তের সন্ধান পেয়েছে। বাঙালি মুসলমান সমাজ শিল্প এবং সংস্কৃতি-চিন্তার ক্ষেত্রে নজরুলের মতো আর কারো কাছে অত বিপুল পরিমাণে ঋণী নয়। সাস্প্রতিক পেক্ষাপটে কবি নজরুলকে বেশী প্রয়োজন -- কবি নজরুল,জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ। অসাম্প্রদায়িক,শোষণ-বঞ্চনাহীন বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা। কিন্তু রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আজ কি হচ্ছে? চারিদকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে, শোষণ-বঞ্চণা আর অসামঞ্জস্যতার ঘেড়াটোপে বন্দী, মুক্তি ও স্বাধীনতা যেন বে-মানান শব্দ। শাসকের শোষণের খড়গ যেন প্রতিনিয়ত আমাদের বলি দিচ্ছে। বিবেকহীন অসভ্য সমাজের অপসংস্কৃতির ধারার মধ্যে যেন আমরা ডুবতে চলেছি। এ প্রেক্ষপটে আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে রক্ষিবো কি ভাবে ? এ প্রশ্নের সমাধান পেতেই কবি নজরুল আমাদের বেশী প্রয়োজন। ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চেতনায় আমরা নজরুল চাই। আমরা বাঙালি, আমরা নজরুলকে চাই। জোর আওয়াজ তুলতে হবে চারদিকে আমরা নজরুলকে চাই। পত্রিকা লেখা ছাপবে,; টেলিভিশন অনুষ্ঠানের পর অনুষ্ঠান করবে; সরকারের অর্থসহযোগে নানা জায়গায় হচ্ছে বড় বড় আয়োজন করা হবে; অন্য সংগঠনগুলোও পিছিয়ে থাকবে কেন? তারাও সভা ও বক্তৃতা আয়োজনে এক পা এগিয়ে আসুক। সবারই এক কথা, যার মর্মার্থ হোক : 'নজরুলকে চাই'। কিন্তু কোন নজরুল আমরা চাই, সে কথা আজ আমাদেও স্পষ্ট কওে বলতে হবে। প্রকৃত অর্থে আমরা কোন নজরুলকে চাই সেটা ভুলতেই বসেছি। আসলে কোন নজরুলকে আমরা চাই তা এখনো ঠিকই হয়নি। তাই চারদিকে 'নজরুরল' 'নজরুল' বলে চিৎকার উঠলেও এই মহাত্মাকে ধারণ করতে পারেনি বাঙালি। আজও নজরুল মানে একটি-দুটি কবিতা; নজরুল মানে কিছু গান; নজরুল মানে কিছু অতিপরিচিত কথা ছাড়া আর কিছু নয়। তাহলে নজরুলের পরিচয় কি এটুকুই? কেউ কেউ আবার নজরুল মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে বিশেষ একজন ধর্মীয় প্রতিনিধি বলে?

সম্পর্কিত সংবাদ

উল্লাপাড়ায় ষাঁড়ের শিংয়ের আঘাতে গৃহবধুর মৃত্যু

অপরাধ

উল্লাপাড়ায় ষাঁড়ের শিংয়ের আঘাতে গৃহবধুর মৃত্যু

তানিম তূর্যঃ সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ষাঁড়ের শিংয়ের আঘাতে খুশি বেগম (৩২) নামে এক গৃহবধুরর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার বিক...

শাহজাদপুরে পৌরসভা ও অগ্নিবীণা সংসদে ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

দিনের বিশেষ নিউজ

শাহজাদপুরে পৌরসভা ও অগ্নিবীণা সংসদে ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি : আজ শুক্রবার শাহজাদপুর পৌরসভা ও ঐতিহ্যবাহী অরাজনৈতিক সংগঠন অগ্নিবীণা সংসদের উদ্যোগে ইফত...

উল্লাপাড়ায় নিখোঁজের ৫ ঘন্টা পর শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার

উল্লাপাড়া

উল্লাপাড়ায় নিখোঁজের ৫ ঘন্টা পর শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার

তানিম তূর্যঃ সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় নিখোঁজের ৫ ঘন্টা পর পুকুর থেকে ইয়াম ইসলাম( ৮) নামের এক শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করেছে...

উপজেলা কাপড়ের হাট আড়ৎ মালিক সমিতির পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত

অর্থ-বাণিজ্য

উপজেলা কাপড়ের হাট আড়ৎ মালিক সমিতির পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত

শাহজাদপুর উপজেলা সংবাদদাতাঃ শাহজাদপুর উপজেলার কাপড়ের হাট আড়ৎ মালিক সমিতির নব-নির্বাচিত ক...

নববর্ষ পহেলা বৈশাখ নিয়ে নানা কথা

উপ-সম্পাদকীয়

নববর্ষ পহেলা বৈশাখ নিয়ে নানা কথা

জামায়াত নেতা নিজামীর রায় বুধবার