শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
12 আবুল বাশার :-আজ পহেলা বৈশাখ আজ থেকে শুরু হলো ১৪২২ বঙ্গাব্দ। বর্তমানে ২০১৫ গ্রেগরিয় সাল। এর সঙ্গে আকবরের সিংহাসন আহরণের বছর বিয়োগ করলে ৪৫৯ বছর পাই এবং এই বিয়োগ ফল ১৫৫৬ সালে যে হিজরি বছর ছিল ৯৬৩ তা যোগ করলে আমরা খুব সহজেই {(২০১৫-১৫৫৬)= ৪৫৯ বছর + ৯৬৩ হিজরি= ১৪২২ সন)} কাঙ্ক্ষিত বর্ষ পেয়ে যাই। উল্লেখ্য যে, ইংরেজি বর্ষ ও বঙ্গাব্দের মধ্যে ৫৯৩ বছর ৩ মাস ১৩ দিনের ব্যবধান লক্ষ করা যায়। এ অনুযায়ী দেখা যায়, ১৯৫৪ সালের ১৪ই এপ্রিল (১৩৬১ বঙ্গাব্দ) যুক্তফ্রন্ট সরকার নববর্ষ উদযাপনে প্রথম সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। যা বাংলাদেশে আজও বর্তমান। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা একদিন পরে নববর্ষ উদযাপন করে। বাংলা সন-তারিখের এই অসামঞ্জস্যের ফলে একই ভাষাভাষী ও বঙ্গাব্দের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল জয়ন্তী, বসন্ত, বৈশাখ উদযাপন হয় ভিন্ন ভিন্ন দিনে। যার কারণে এই অত্যাধুনিক যুগেও বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি। এর জন্য বরং পশ্চিমবঙ্গের পণ্ডিতরাই দায়ী। কারণ ড.মেঘনাধ সাহার বিজ্ঞানসম্মত সংস্কার প্রস্তাব মেনেই বাংলাদেশে পঞ্জিকা সংস্কার করা হয়। পরবর্তীকালে ভারত সরকার ড. সাহার প্রস্তাবের কিছু সংশোধন করে এস. পি. পাণ্ডে কমিটি ১৪ই এপ্রিলে পহেলা বৈশাখ নির্দিষ্ট করে দেন। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় এই জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্মত সংস্কার এখনও স্থির হয়নি যা তাদের সরকার ও পণ্ডিতদের কূপমণ্ডুকতার পরিচয় বহন করে। এখন সময় এসেছে, বাংলা সনের অসামঞ্জস্য দূর করে বিশ্ববাঙালিকে একই যাত্রায় মিলিত করা। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, ভাষাবিজ্ঞানী প্রভূত পণ্ডিত ও বিদ্যানদের উচিত সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়া। নয়তো বিশ্ববাঙালির বিশ্বজয়ে ‘মলমাসের’ দুর্গন্ধ থেকেই যাবে। ??????????? বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন নিয়ে রয়েছে বিস্তর মতামত। এই উপমহাদেশে পূজা-পার্বণের সঙ্গে চান্দ্র মাসের বেশ সামঞ্জস্য রয়েছে। আর সৌর মাস ঋতুভিত্তিক চাষাবাদের জন্য সহায়ক। এই বিতর্কের সমাধানে ১৯৫২ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহা সর্বভারতে পঞ্জিকা সংস্কারের প্রস্তাব করেন। পূর্ববাংলায় ১৯৬৩ সালে ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘শহীদুল্লাহ কমিটি’ ড. সাহার সংস্কারকে মেনে নিয়ে চান্দ্র বর্ষপঞ্জির ধরনকে বাদ দিয়ে সৌর মাস অনুসারে বাংলা পঞ্জিকা তৈরি করার প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা সন চালুর ওপর বঙ্গবন্ধুর সরকার গুরুত্ব দেন। অবশেষে ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে পূর্বোক্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরির নির্দেশ জারি হয়। কিন্তু লিপইয়ারসহ অন্যান্য অস্পষ্টতা ও জটিলতা থাকায় ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমির ‘বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কার কমিটি’ দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বাংলা মাস ও ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে গ্রামবাংলার মানুষের সম্পৃক্ততার কথা বিবেচনায় নিয়ে শহীদুল্লাহ কমিটির প্রস্তাবের অনুসমর্থনে গ্রেগরিয় ক্যালেন্ডারের ১৪ই এপ্রিলকে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৯৫ সালে বাংলা তারিখ পরিবর্তনের সময় মধ্যরাতকে ধরে বাংলা বর্ষপঞ্জিকে বিশ্বজনীন রূপ দেওয়া হয়েছে। এত কিছুর পরও কি বিশ্ববাঙালির কাছে এই বিজ্ঞানভিত্তিক বর্ষপঞ্জিকা গৃহীত হয়েছে? তাহলে এর পেছনের কিছু কথা বলে নিই। এই মত এখন সর্বজন স্বীকৃত যে, সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আহরণের বছর ১৫৫৬ সাল ছিল ৯৬৩ হিজরি। আর এই হিজরিকে প্রথম বাংলা বছর হিসেবে ধরা হয়। 4 তবে এটি সর্বজনবিদিত যে, সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে। ২৯ বছর রাজত্ব করার পর তিনি পঞ্জিকা ও বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। হিজরি সন ও সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছরকে যুক্ত করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়।বলা হয়ে থাকে যে ফসল কাটার মৌসুমে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য এই সন চালু করা হয়েছিল। হিজরি সন হলো চান্দ্রসন, চাঁদ দেখে গণনার ওপর এই সনের ভিত্তি। বাংলা সৌরসন। সৌরসনে দিনক্ষণ গণনা সহজ এবং এর একটি নির্দিষ্ট ভিত্তি আছে। সম্রাট আকবরের উপদেষ্টা আমির ফতেউল্লাহ সিরাজী বাংলা মাসের নামগুলো নক্ষত্রের নাম থেকে নিয়ে সৌরমাসের দিন মিলিয়ে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। এ ব্যাপারে ১৫৮৫ সালের ১০ মার্চ সম্রাটের নির্দেশনামা জারি হয়। তবে এর কার্যকারিতা দেখানো হয় ১৫৫৬ সালের ১১ মার্চ থেকে। কারণ ওই দিনটি ছিল সম্রাট আকবরের সিংহাসনে বসার তারিখ। সেই থেকে শুরু। এই গল্পের দুটো দিক আছে। প্রথমত, বাংলা বছর বা সালের উদ্ভব কী করে হল? এ সম্বন্ধে আবার মত আছে দুটি। বেশিরভাগ পণ্ডিতই একমত যে, ইসলামের হিজরি সন থেকেই বাংলা সালকে গ্রহণ করা হয়েছে। হিজরি সালের উৎপত্তি ৬৬২ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু হিজরিতে চান্দ্রবছর প্রচলিত ছিল। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর যখন সিংহাসনে বসেন, তিনি নাকি লক্ষ্য করেন চান্দ্র (চাঁদের কলার হ্রাস-বৃদ্ধি, কৃষ্ণ-শুক্ল দুই পক্ষে এক মাস) অনুযায়ী বছর ধরলে প্রশাসনের অসুবিধা হয়। তাই সৌর হিসাব গ্রহণ করে ৩৬৫ দিনের বছরে হিজরিকে রূপান্তরিত করেন এবং তখন থেকে অর্থাৎ ৯৬৩ সৌর হিজরি সালকে বাংলা ৯৬৩ সাল ধরে বাংলা সালের গণনা শুরু হয়। আরেকটি মত হল, বাংলা সালের উৎপত্তি হয়েছে বাংলার প্রাচীন হিন্দু রাজা শশাঙ্কের আমল থেকে, আনুমানিক ৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে। এটি কোনো ঐতিহাসিক তথ্যের দ্বারা সমর্থিত নয়, নিছকই অনুমান। শশাঙ্কের জীবনের কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে এ বছর যুক্ত নয়। বাংলা সালকে একটা হিন্দু চেহারা দেয়ার জন্য পেছন থেকে হিসাব করে ওই ৫৬৮ সালে পৌঁছানো গেছে, কিন্তু শশাঙ্কের জীবৎকালে হলেও ওই বছরেই কেন বাংলা সালের শুরু হল তা কেউ বলতে পারেননি। কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা শশাঙ্কের রাজত্বকালে ওই বছরে ঘটেনি, তাহলে হঠাৎ নতুন সাল শুরু হতে যাবে কেন? 5 কৃষির সঙ্গে বাংলা নববর্ষের ঘনিষ্ঠতা এ সন প্রবর্তনের সূচনা থেকেই। আদিকাল হতে এ আধুনিক যুগ পর্যন্ত কৃষিকাজের সঙ্গে ঋতুর রয়েছে ঘনিষ্ট সম্পর্ক। ঋতুর ওপর ভিত্তি করেই হয় ফসলের চাষাবাদ। মুঘল সম্রাট আকবর প্রচলন করেন বাংলা সনের। এর আগে মুঘল বাদশাহগণ রাজকাজে ও নথিপত্রে ব্যবহার করতেন হিজরী সন। হিজরী চান্দ্র বছর, যা ন্যূনধিক ৩৫৪ দিনে পূর্ণ হয়। কিন্তু সৌরবছর পূর্ণ হয় ৩৬৫ দিনে। বছরে প্রায় ১১ দিন পার্থক্য হওয়ায় হিজরী সন আবর্তিত হয় এবং ৩৩ বছরের মাথায় সৌরবছরের তুলনায় এক বছর বৃদ্ধি পায়। ফসল উৎপাদনে ঋতুর ভিত্তিতে কৃষকের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতে হলে সারাদেশে একটি অভিন্ন সৌরবছরের প্রয়োজন দেখা দেয়। এ ধারণা থেকেই সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ অথবা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তা কার্যকর হয় তার সিংহাসন আরোহণের সময় অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নবেম্বর থেকে। আকবরের সভাসদ ফতেউল্লাহ খান সিরাজী বাংলা সন প্রবর্তনের কাজটি সম্পন্ন করেন। প্রথম এ সনের নাম ছিল ফসলী সন। পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। বাংলা সন যে হিজরী চান্দ্র সনেরই সৌররূপ তা সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ মুসলিম। এই বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর হৃদয়-মনে বিম্বিত, গ্রন্থিত ও লালিত বিশ্বাসের শাশ্বত আলোকধারার চির সুন্দর উৎস থেকে উদ্ভূত ও উৎসারিত রুচিনীতি যে আলোকোজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন রুচিবোধের সুরম্য সড়ক নির্মাণ করেছে সেটাই এ দেশের মানুষের সংস্কৃতির আসল পরিচয়। একটি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সেই জাতির প্রকৃত পরিচয় বিশ্ব দরবারে সমুন্নত করে তোলে এবং সেই জাতির নিজস্বতাকে সুদৃঢ় বুনিয়াদের ওপর সংস্থাপিত করে। সেই বুনিয়াদের ওপর গড়ে ওঠা সুবিশাল সাংস্কৃতিক বলয় অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ থেকে, বিপরীতমুখী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে জাতিকে রক্ষা করে এবং সেই জাতির স্বকীয়তাকেও রক্ষা করে। সংস্কৃতির নানামাত্রিক উপাদান রয়েছে। সন বা বর্ষ গণনারীতি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রধান প্রধান উপাদানসমূহের অন্যতম। বাংলাদেশে বর্তমানে যে সনগুলোর প্রচলন রয়েছে তা হচ্ছে হিজরী সন, বাংলা সন ও ইংরেজী সন। ইংরেজী সনকে সংক্ষেপে বলা হয় এডি যার, পূর্ণ বাক্য হচ্ছে অহহড় উড়সরহরং অর্থাৎ আমাদের প্রভুর বছরে। এই ইংরেজী সন আমাদের দেশে খ্রিস্টাব্দ হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ ইংরেজী সনকে ঈসায়ী সন বলার প্রয়াসী হন, কিন্তু মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত মাসিক মোহাম্মদীতে খ্রিস্টাব্দ ঈসাব্দ শীর্ষক আলোচনায় ঈসাব্দ লেখায় আপত্তি জানিয়ে বলা হয় যে, বাইবেলে বর্ণিত যিশুখ্রিস্ট এবং কুরআনে বর্ণিত হযরত ঈসার শিক্ষা ও জীবনের আদর্শ সম্বন্ধে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। বাইবেলের যিশু ও কুরআনের ঈসা দু’জন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যক্তি। খ্রিস্টাব্দকে ঈসাব্দ বলিয়া গ্রহণ করিলে উভয়ের অভিন্নতা স্বীকার করা হয়। এই বাংলা নববর্ষের ইতিহাস খুব পুরনো নয়। খুব সম্ভব বাংলা সনের সঙ্গে যোগ আছে বাংলা নববর্ষ পালনের। বাংলা সনের ভিত্তি হিজরী চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসন। বাংলার তৃণমূল পর্যায়ে গ্রহণ করা হয়েছিল বাংলা সন। এর একটি কারণ হতে পারে এই যে, বাংলা সনের ভিত্তি কৃষি এবং বাংলা সনের শুরম্নর সময়টা কৃষকের খাজনা আদায়ের। যেমন, চৈত্রে বৃষ্টি হলেও কিন্তু কৃষক লাঙ্গল দেয় না খেতে, লাঙ্গল দেয়া হয় সাধারণত বৈশাখে। বৃষ্টির কামনাও সে জন্য। অবশ্য, চৈত্রে বৃষ্টি হলে একেবারে লাঙ্গল দেয়া হয় না সেটিও ঠিক নয়। যাই হোক, এখনও সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গ্রামের, তার নিজকর্ম সম্পাদন করেন বাংলা সনের নিরিখে। আর শহরবাসীরা জুলিয়াস ক্যালেন্ডারের নিরিখে। বাংলা নববর্ষ নিয়ে এ যাবত অনেক গবেষণা হয়েছে। যে যুক্তিটি এখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য তা হলো- মুঘলের তৃতীয় সম্রাট আকবর বঙ্গাব্দকে চান্দ্র (লুনার) সন থেকে সৌর (সোলার) সনে রূপান্তর করেন। খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ফসলের মৌসুমের দিকে দৃষ্টি দিয়ে হিজরী মাসের বদলে বাংলা সনকে গ্রেগরিয়ান সোলার ক্যালেন্ডারের পাশাপাশি রাখা হয়। চান্দ্র মাস বা হিজরী মাস গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে প্রতিবছর গড়ে ১১ দিন করে পিছিয়ে যায়। চাঁদের হিসাব অনুযায়ী গড়ে ২৯ দশমিক ৫৩০৫৮৯ দিনে হয় এক মাস। ১২ মাস মিলে এক বছর হয় ৩শ’ ৫৪ দিন। আর সৌর বর্ষ বা সোলার ক্যালেন্ডারে এক বছর হয় ৩শ’ ৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট। সম্রাট আকবর ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বাংলা সনকে সৌর সনের আওতায় নিয়ে আসেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় এই রূপান্তরে আকবরের দরবারের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেহ সিরাজী বড় ভূমিকা পালন করেন। ওই সময়ে ফসল ঘরে তোলা হতো অগ্রহায়ণে। অগ্রহায়ণেই খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা হয়। সে কালে অগ্রহায়ণই ছিল বাংলার প্রথম মাস। অন্যান্য মাসের নাম ওই সময়ের নক্ষত্রের নামের সঙ্গে মিল রেখে ঠিক করা হয়। যেমন বৈশাখ নাম এসেছে নক্ষত্র বিশাখা থেকে। বঙ্গাব্দ মুঘলী সন ও ফসলী সন হিসাবেও পরিচিতি পায়। দীর্ঘ সময় পরে বৈশাখ বাংলার প্রথম মাসে পরিণত হয়। বাঙালীর শেকড়ের সত্তায় বাংলা নববর্ষ এতটাই আনন্দের যে শহর বন্দরে আনুষ্ঠানিক দৃশ্যমান মেলার সঙ্গে বাঙালীর প্রতিটি ঘরে গ্রামের কিষাণ ও গৃহস্থ বাড়ির আঙ্গিনায় পারিবারিক বন্ধনে অদৃশ্য মেলা বসে। বাঙালির বর্ষপঞ্জি বা পঞ্জিকা বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। নববর্ষ উৎসব সব দেশেই সর্বজনীন উৎসব। সে জন্যই সমাজ বিকাশের ধারায় একটা উন্নত পর্যায়েই কোনো জাতির নববর্ষ উৎসব ও তার পঞ্জিকার উদ্ভব ঘটে। তাই এর একটা ধারাবাহিক ইতিহাস থাকে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের দিক থেকে ব্যাখ্যা করলে বাংলায় বর্ষবরণ ও বাঙালির বর্ষপঞ্জি উদ্ভাবনের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা অন্যান্য সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত প্রক্রিয়ারই পরিচয় বহন করে। এ ক্ষেত্রে ইংরেজি 'ক্যালেন্ডার' শব্দটি মূলে লাতিন শব্দজাত। যত দূর জানা যায়, এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো : 'হিসাব-বই'। অন্যদিকে, ইংরেজি 'আলমানাক' শব্দটি আরবি ভাষা থেকে এসেছে বলে অনুমিত হয়। 'আলমানাক' যে অর্থ প্রকাশ করে তার বাংলা অর্থ করলে 'পঞ্জিকা' বলা যেতে পারে। ক্যালেন্ডার বলি, আর আলমানাক বলি_ দুয়েরই জন্মস্থান প্রাচীন মিসর। পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন পঞ্জিকা মিসরে প্রস্তুত হয়েছিল বলে পঞ্জিকাকে মিসরীয় সভ্যতার অবদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মিসরীয়রাই প্রায় ৬ হাজার বছর আগে চান্দ্র হিসাবের ভুল চিহ্নিত করে সৌর পদ্ধতির গণনা শুরু করে। নীলনদ-তীরবর্তী এই বাসিন্দারা অত আগে প্রায় ৩৬৫ দিনে বছরের হিসাবের খুব কাছাকাছি পেঁছেছিল। এখানে খুব তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো কৃষির সঙ্গে পঞ্জিকার অপরিহার্য সম্পর্ক। মিসরকে নীলনদের দান বলেছেন বিশ্বের প্রথম ঐতিহাসিক হেরোডেটাস। নীলনদের একদিকে সবুজ কৃষিক্ষেত্র, অন্যদিকে ধূসর মরুভূমি। নীলনদ না থাকলে মিসর কৃষি সভ্যতার জননীস্বরূপ হতে পারত না। অন্যদিকে, পাশ্চাত্যের সমুদ্রতীরবর্তী রোমে রোমান ক্যালেন্ডার (ইংরেজি ক্যালেন্ডার কথাটি ভুল। কারণ ওই ক্যালেন্ডারের সঙ্গে রোমের ক্যাথলিক ধর্মের সম্পর্ক ছিল_ প্রটেস্টান্ট ইংরেজরা তাই ওই ক্যালেন্ডার ১৭০ বছর পর্যন্ত গ্রহণ করেনি) বা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়ে তা পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত বহাল থাকে। পরে সে ক্যালেন্ডারের ভুলভ্রান্তি শুধরে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়। সে ক্যালেন্ডার এখন সারা পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে চালু হয়ে গেছে। আমরা জেনেছি, কৃষির সঙ্গে পঞ্জিকার সম্পর্ক নিবিড় ও অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ আমরা মিসরীয় ক্যালেন্ডার এবং ইউরোপের জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের কথা বলব। মিসরীয় সভ্যতায় বিশ্বের প্রথম যে ক্যালেন্ডার তৈরি হয় তাতে কৃষি উৎপাদন পদ্ধতির প্রভাবই ছিল প্রধান। কারণ কৃষি ঋতুনির্ভর। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে ফসলের বীজ সংগ্রহ, বীজ বপন, ফসলের পরিচর্যা, ফসল কাটা_ সবকিছুই সময়মতো করা চাই। তাই চান্দ্র ক্যালেন্ডার কৃষির জন্য উপযোগী নয়। চান্দ্র ক্যালেন্ডারে বছরে সাড়ে ১০ দিনের হেরফের হয়। তাই চান্দ্র ক্যালেন্ডার (হিজরি ইত্যাদি) অনুসরণ করলে এ বছরে যখন ফসল বোনা হবে, তিন বছর পরে তা এক মাস পিছিয়ে যাবে। কৃষি উৎপাদন ও তার ব্যবস্থাপনায় তাই চান্দ্র ক্যালেন্ডারের পরিবর্তে সৌর ক্যালেন্ডার প্রচলন হয়। মিসরীয় ক্যালেন্ডারেই এ সংশোধন করা হয়। বহু পরে (১৫৫২) ইউরোপের জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ত্রুটি দূর করে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চন্দ্র ও সূর্যের আবর্তনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়। ফলে জাগতিক কর্মকাণ্ড সূর্যের আবর্তননির্ভর বা ঋতুনির্ভর আর ধর্মীয় উৎসবাদি চন্দ্রকলার হ্রাসবৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আসলে পঞ্জিকার মধ্যেও আমাদের সমাজ জীবনের ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ দুই সত্তাই একত্রে অবস্থান করাতে পঞ্জিকা জীবনের পূর্ণতারও প্রতীক।

সম্পর্কিত সংবাদ

শাহজাদপুরে আবাসিক হোটেল ব্যবসার করুন অবস্থা, প্রনোদনা চায় ব্যবসায়ীরা

অর্থ-বাণিজ্য

শাহজাদপুরে আবাসিক হোটেল ব্যবসার করুন অবস্থা, প্রনোদনা চায় ব্যবসায়ীরা

এ বছরের ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া টানা একমাসের লকডাউনে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের আবাসিক হোটেলগুলো ফাকা পড়ে আছে। স্টাফ বেতন,...

১১ আগস্ট থেকে সীমিত পরিসরে গণপরিবহন চালু

বাংলাদেশ

১১ আগস্ট থেকে সীমিত পরিসরে গণপরিবহন চালু

মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) ভার্চুয়ালি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে সচিবালয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদে...

শাহজাদপুরে দুই মেয়েকে বিষ পান করিয়ে মায়ের আত্মহত্যা

শাহজাদপুর

শাহজাদপুরে দুই মেয়েকে বিষ পান করিয়ে মায়ের আত্মহত্যা

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের ইসলামপুর ডায়া নতুনপাড়া গ্রামে স্বামীর সাথে ঝগড়া করে বিষপান করে ম...