মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

শামছুর রহমান শিশির: ‘দিন যে আর কাটে না দাদা!মাটির জিনিস পত্তের ত্যেমন চাহিদ্যা নাই, কামও (কাজ) কুইমচ্যে, মাটির দাম বাইরচে, খড়ির (জ্বালানী) দাম বাইরচে। খালি হব পাইল্যেই খরচ বাইরচ্যে। অইন্য কোন কামও পারি ন্যা যে হেই কাম কইরত্যাম।এ্যাহন ডাইল,চাইলের যে দাম ওইছে তাতে কিবাবে হকগোলেক লিয়্যা সামনের দিনগুলো চইলব্যে, হেই দুঃচিন্ত্যায়ই কইরতেছি।’-হ্যাঁ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এমন বক্তব্য শুধু শাহজাদপুরের প্রাণনাথপুর পালপাড়ার এক হতভাগা মৃৎশিল্পীর নয় ! শাহজাদপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার শত শত মৃৎশিল্পীদের বর্তমানে একই হাল পরিলক্ষিত হচ্ছে। বংশপরষ্পরায় জেনে ও শিখে আসা ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন পেশা মৃৎশিল্পের ধারক বাহক শাহজাদপুরসহ আশেপাশের শত শত মৃৎশিল্পীদের অবস্থা বর্তমানে বড়ই করুণ। বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে বর্তমানে মৃৎশিল্পীরা পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছে। আর যারা এখনো এ পেশায় সম্পৃক্ত রয়েছে তাদের খেয়ে না খেয়ে মানবেতর দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। জানা গেছে, বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক যান্ত্রিক যুগে তৈরিকৃত প্লাষ্টিক, এ্যালুমিনিয়ামসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি জিনিসপত্রের আগ্রাসনে দেশের ঐহিত্যবাহী প্রাচীনতম মৃৎশিল্প বর্তমানে হুমকির সন্মুখীন হয়ে পড়েছে। এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত শত শত শিল্পীরা তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাটির হাড়ি,পাতিল,স্যানেটারী ল্যাট্রিনের চাক, পাটা, খাদা, কোলা, সড়া, ব্যাংক, ঝাঝুর ছাকনা, চারি, কাটাখোলা, ভাপাপিঠার খোলা, সাতখোলা, পাঁচখোলা, তিনখোলাসহ বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র তৈরি করে বাজারে নিয়ে গিয়ে পড়ছে মহাবিপাকে। অতিকষ্টে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও তৈরিকৃত মাটির জিনিসপত্রের ন্যয্য দাম না পেয়ে অনেক মৃৎ শিল্পীরাই ইতিমধ্যে লোকসানের ভার সইতে না পেরে ঐতিহ্যবাহী পেশা বদলিয়ে অন্য পেশায় যোগদান করেছে। অপরদিকে, মৃৎ শিল্পীদের তৈরিকৃত মাটির তৈরি বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্রের চাহিদা দিন দিন হ্রাস পাওয়ায় তৈরিকৃত ওইসব মাটির সামগ্রী হাটবাজারে আশানুরূপ বেচাবিক্রি হচ্ছে না। ফলে দুই দিক থেকেই শাহজাদপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার শত শত মৃৎশিল্পীরা যন্ত্রনার যাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে খেয়ে না খেয়ে কোন মতে এখনোও গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ওই পেশাটিকে টিকিয়ে রেখেছে।এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পরে হয়তো মাটির তৈরি জিনিসপত্র পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাদুঘরে স্থান করে নেবে-এমন আশংকা স্থানীয় মৃৎশিল্পীদের।দিনভর অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাটির জিনিসপত্র তৈরি ও বিক্রি করে তারা যে অর্থ আয় করছে তা দিয়ে তাদের ভরণপোষনই অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে।এছাড়া মাটি ও মাটি পোড়ানোর জ্বালানী ব্যায় বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের মাটির জিনিসপত্র তৈরির ব্যায় বহুলাংশে বৃদ্ধি পেলেও তাদের আয় না বাড়ায় অতিকষ্টে পরিবার পরিজন নিয়ে তাদের ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটছে।তার পরেও‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’এর মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় উর্ধ্বগতিতে রীতিমতো মৃৎশিল্পীদের জীবনজীবিকার প্রশ্নে কালো মেঘের ঘনঘটার মতো চরম অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। শাহজাদপুর উপজেলার প্রাণনাথপুর পালপাড়া সরেজমিন পরিদর্শনকালে অসংখ্য মৃৎ শিল্পীদের সাথে এ প্রতিবেদকের আলাপ হয়।আলাপকালে প্রাননাথপুর পালপাড়া মহল্লার বেশ কয়েকজন মৃৎশিল্পী এ প্রতিনিধিকে বলেন, বংশ পরষ্পরায় জেনে ও শিখে আসা মৃৎ শিল্পের কাজে নিয়োজিত পাল সম্প্রদায়ের (মৃৎ শিল্পী) অনেকেই লোকসানের ভার সইতে না পেরে এ পেশা ত্যাগ করে অন্য পেশায় আত্মনিয়োগ করেছে। পেশাটি পরিশ্রমের তুলনায় লাভজনক না হওয়ায় শাহজাদপুরসহ এর পার্শ্ববর্তী উল্লাপাড়া, চৌহালী, বেলকুচি, কামারখন্দ, বেড়া,সাঁথিয়া ও সুজানগরের শত শত মৃৎশিল্পীদের বর্তমানে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা ক্রমাগত হ্রাস পেতে পেতে বর্তমানে একেবারেই নীচে নেমে এসেছে। অপরদিকে মাটি ও পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত জ্বালানী ব্যায় বেড়েছে। সব জিনিসের দাম বাড়ায় জীবনযাত্রার সার্বিক ব্যায় বহুলাংশে বৃদ্ধি পেলেও দাম বাড়েনি তৈরিকৃত মাটির পন্যেও চাহিদা ও দাম। ফলে বহুমুখী সমস্যার যাতাকলে পিষ্ট হয়ে এক সময়ের অতি জনপ্রিয় ও গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প হুমকির সন্মুখীন হয়ে পড়েছে। শাহজাদপুরের প্রাণনাথপুর পালপাড়া মহল্লার মহাদেব পাল, রংলাল পাল, সংকর পাল, ভোম্বল পাল, রনজিত পাল, অজিত পাল, অসিত পাল, অনিল পাল, অনন্ত পাল, পলান পাল, অধীর পাল, সুশীল পাল, নিখিল পাল, সনজয় পাল, সুজন পাল, সুশীল পাল, নিখিল পাল, তপন পাল, গোপাল পাল, পরিতোষ পাল, রুপম পাল, রাজকুমার পাল, বিমল পাল, প্রদীপ পাল, কৃষনো পাল ও সংকর পালসহ পার্শ্ববর্তী উল্লাপাড়া, চৌহালী, বেলকুচি, কামারখন্দ, বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর উপজেলায় কর্মরত শত শত মৃৎ শিল্পীদের বর্তমানে প্রতিটি দিন কাটছে অনাদরে, অর্ধাহারে। স্থানীয় মৃৎশিল্পীরা জানান, প্রতি বছর পূঁজার সময় একেকটি প্রতিমা তৈরি করে তাদের আয় হয় ৬/৭ হাজার টাকা। এক ট্রাক এঁটেল মাটি ক্রয় করতে হচ্ছে এক হাজার টাকায়। আবহাওয়া খারাপ থাকলে ও বৃষ্টিপাত হলে তাদের কাজ বন্ধ রাখতে হয়।এছাড়া জ্বালানী ব্যায়ও অতীতের তুলনায় বহুলাংশে বৃদ্ধি পাওয়ায় তৈরিকৃত সকল মাটির পন্যের উৎপাদন ব্যায় বহুলাংশে বেড়েছে। কিন্তু তৈরিকৃত মাটির জিনিসপত্রের দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় ও চাহিদা অমিত পরিমানে হ্রাস পাওয়ায় বর্তমানে শত শত মৃৎশিল্পীরা রীতিমতো চোঁখেমুখে সর্ষের ফুল দেখছে। অভাব অনটন নিত্যসঙ্গী হওয়ায় অভাবের তাড়নায় ওই পল্লীর অনেক শিশুকিশোর বিদ্যালয়ে যেতে না পেরে ঝড়ে পড়ছে। অভাবজনিত কারণে ছোটবেলা থেকেই ওইসব শিশুদের কাজে নিযুক্ত হতে বাধ্য হতে হচ্ছে। সমাজপতি বা কোন সরকারি বেসরকারি সংগঠন ওদের মতো চির অবহেলিত, চির পতিত, চির অপাংক্তেয় ভাগ্যবিড়ম্বিত মৃৎ শিল্পীদের ভাগ্যোন্নয়নে এগিয়ে আসতে দেখা না যাওয়ায় ওদের বিচারের রায় নিরবে নিভৃতে কাঁদছে প্রতিটি মুহুর্তে। আধুনিক যান্ত্রিক উপায়ে প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন ধরনের প্লাষ্টিক, এ্যালুমিনিয়মসহ ধাতব শিল্পের আগ্রাসনে বর্তমানে মৃৎ শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে দেশপট থেকে। অভাব অনটন আর ঋণপানে জর্জরিত হয়ে শাহজাদপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার শত শত মৃৎ শিল্পীদের জীবন চালাতে চরম হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা ওই ঐহিত্যবাহী এ পেশাটি ধরে রাখতে অনেক ত্যাগ, কষ্ট, দুঃখ সহ্য করেও পেশাটি টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতির মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন ধরনের ধাতব দ্রব্যের আগ্রাসনে আর কতদিন ঐতিহ্যবাহী ওই পেশাটি তারা ধরে রাখতে পারবেন তা নিয়ে তাদের মধ্যে নানা প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিয়েছে।

সম্পর্কিত সংবাদ

শাহজাদপুরে মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশারের নামে সড়কের নামকরণ’র উদ্বোধন

শাহজাদপুর

শাহজাদপুরে মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশারের নামে সড়কের নামকরণ’র উদ্বোধন

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে শাহজাদপুর সংবাদ ডটকম এর প্রধান সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার-এর নামে সড়ক নামকরণের উদ্বোধন...

নানা অব্যবস্থাপণায় চলছে পাবনা সেচ প্রকল্প

নানা অব্যবস্থাপণায় চলছে পাবনা সেচ প্রকল্প

পাবনা প্রতিনিধি :-নানা অব্যবস্থাপণার মধ্যদিয়ে চালু রয়েছে পবনা সেচ প্রকল্প। অবহেলা ও অনিয়মের কারণে সেচ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ...

এইডস আতঙ্কের ব্যাপ্তি, প্রতিরোধেই মিলবে মুক্তি

সম্পাদকীয়

এইডস আতঙ্কের ব্যাপ্তি, প্রতিরোধেই মিলবে মুক্তি

লাইট হাউস শাহজাদপুর ডিআইসি আয়েজিত প্রজেক্ট ফ্যসিলিটেশন টিমের ২০১৫ সালের ১ম সভায় উপস্থাপি...

শাহজাদপুরে ওয়াজ শুনে বাড়ি ফেরার পথে সড়কে প্রাণ গেল শিশু হোসাইনের

শাহজাদপুর

শাহজাদপুরে ওয়াজ শুনে বাড়ি ফেরার পথে সড়কে প্রাণ গেল শিশু হোসাইনের

ওয়াজ শুনে বাড়ি ফেরার পথে মহাসড়ক পাড়ি দেয়ার সময় পাবনা থেকে ঢাকাগামী একটি মাইক্রোবাস চাপায় হোসাইন সরদার নামের এক ৯ বছরের শ...

বৈশাখী কাপড় তৈরিতে ব্যস্ত শাহজাদপুরসহ সিরাজগঞ্জের তাঁতী শ্রমিকেরা

অর্থ-বাণিজ্য

বৈশাখী কাপড় তৈরিতে ব্যস্ত শাহজাদপুরসহ সিরাজগঞ্জের তাঁতী শ্রমিকেরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, শাহজাদপুর : পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে দেশের তাঁতশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু শাহজাদপুর, বিন্দু সিরাজগঞ্জের ত...

শাহজাদপুরে দূর্ঘটনায় নিহত পরিবারে ৪০ হাজার টাকার চেক বিতরণ