বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

'এ অঞ্চলে মোট ২৫-৩০ প্রকারের মিষ্টি প্রস্তুত হয়। এই মিষ্টিগুলোর উৎপত্তি বা ইতিহাসের ব্যাপারে এখানকার হালুইকর বা ময়রারা তেমন সচেতন না। কিন্তু, প্রত্যেকটা আইটেমে তারা মিষ্টি বা ছানার যে মান বজায় রাখতে পারেন সেটা দেশের খুব কম হালুইকরই পারেন', 'বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার'-এর একজন স্বত্বাধিকারী শ্রী আনন্দ কুমার বসাক শাহজাদপুরের মিষ্টি ও মিষ্টি নির্মাতাদের ব্যাপারে এমন মন্তব্য করেছিলেন।   

কাপড়ের হাট, তাঁতশিল্প, গোবাথান, মিল্কভিটা, রবী ঠাকুর এ সবকিছু ছাপিয়ে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের মিষ্টান্ননগরী হিসেবে আরেকটি পরিচয় রয়েছে। তাঁতশিল্প, ব্যবসায়ী শ্রেণির পত্তন, হিন্দু জমিদারি, বাথানভূমির আবাদ, মিল্কভিটা ইত্যাদি শাহজাদপুরে দুধ ও দুধজাত দ্রব্যাদির একটি বিশাল বাজার প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় সরাসরি ভূমিকা রেখেছে। 

শুধু শাহজাদপুর উপজেলা সদরেই কয়েক দশক পুরনো মিষ্টির দোকান আছে পনেরটির বেশি। বংশানুক্রমে এ দোকানগুলোয় দুধজাত দ্রব্যাদি বিক্রি হয়ে আসছে। মোটামুটি সব দোকানেই মেইন আইটেমের মিষ্টিগুলো উৎপাদিত হয়। একেকটি দোকানের একেক আইটেম বিখ্যাত। 

সবচেয়ে মজার ব্যাপারটি হল, মিষ্টির দোকানগুলোর কর্ণধার বা মালিক যে কয়জন আছেন তাদের অধিকাংশই পুরোপুরি হালুইকরি বা মিষ্টির কারিগরি জানেন না। তা সত্ত্বেও, দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে তারা কারিগরদের থেকে কড়ায় গণ্ডায় কাজ বুঝে নিতে পারেন। মূলত, কারিগর শ্রেণি আর মালিক শ্রেণি আলাদা। 

এক দশক আগেও মিষ্টির কারিগরির জ্ঞান কারিগরদের ভেতর পুরুষানুক্রমে প্রবাহিত হত। পূর্বে যারা হালুইকর ছিলেন তাদের সন্তানদের অনেকেই পেশা পরিবর্তনের দিকে ঝুঁকছেন। একসময় শুধু হিন্দুদের ভেতর হালুইকরির প্রবণতা দেখা যেত এখন মুসলমানরাও সমানে হালুইকরি করছেন। 


এই লেখায় শাহজাদপুরে সবচেয়ে প্রখ্যাত পাঁচটি মিষ্টির দোকান ও তাদের হালুইকরি নিয়ে কথা বলা হবে। 


বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার 

বসাক সম্প্রদায় আগে কাপড় বুনোনের কাজ করত। পূর্ববঙ্গে এসে তারা অনেকে পেশা পরিবর্তন করে ফেলে। শাহজাদপুরে সব বসাক তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত নয়। তাদের কেউ কেউ হালুইকরিকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়।  

'বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার'-এর প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় শ্রী ভোলানাথ বসাক স্বাধীনতার দু'এক বছরের মধ্যে কাপড়ের ব্যবসায় মার খেয়ে ভগ্নিপতি পুরাণ ফইজদারকে সঙ্গে নিয়ে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। পুরাণ ফইজদার সেকালে একজন স্বনামধন্য হালুইকর ছিলেন। ভোলানাথ বসাক দোকান চালাতেন, পুরাণ ফইজদার মিষ্টি বানাতেন। এভাবেই বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের যাত্রা শুরু। 

শুরুতে বসাকে ৫-৬ প্রকার মিষ্টি বানানো হলেও বর্তমানে প্রায় ২৮ প্রকার মিষ্টি বানানো হয়। খুব ভোরে খামারিরা দুধ পৌঁছে দিলে দুধ জ্বাল দেওয়া শুরু হয়। মূলত তিনজন কারিগর বসাকে মিষ্টি তৈরি করেন। পলাশ চন্দ্র দাস, বিশ্বনাথ মোদক ও বাসুচন্দ্র পাল। 

'বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার'-এর মুখ্য কর্ণধার ও ভোলানাথ বসাকের বড়ছেলে অসিত কুমার বসাক বলেন, 'মিষ্টির কারিগরি খুব সেনসেটিভ ব্যাপার। একটু হেরফের হলে পুরো পাতিল শেষ। যারা মিষ্টির কারিগরি শিখতে আসেন তাদের শুধু দুধের জ্বাল আর ছানার কারিগরি বোঝাতেই কয়েকবছর লাগে।'

বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ছানার জিলাপি

বসাক মিষ্টান্নের সবচেয়ে প্রচলিত মিষ্টির আইটেমগুলো হল – কালোজাম, দুধজাম, গুড়ের সন্দেশ, স্পেশাল সন্দেশ, রাঘবসাই, রসগোল্লা, রসমালাই, রসমঞ্জুরি, রসকদম, চমচম, ছানার গোল্লা, ছানা, ছানার জিলাপি, রাজভোগ, কাটাভোগ, ঘিয়ে ভাজা পানতোয়া, তেলে ভাজা পানতোয়া, ছোট গোল্লা, লালমন, বেবি সুইট, কেক সুইট, সাদা দই, লাল দই, খুরমা, জিলাপি ইত্যাদি।  

দোকান কর্তৃপক্ষ ও খরিদ্দারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বসাক মিষ্টান্নের সবচেয়ে স্পেশাল আইটেম ছানার জিলাপি ও রসমালাই। তারপরে রাঘবসাই তারপরে সন্দেশ। কলেজ শিক্ষক রেজাউল করিম মিষ্টি কিনতে এসে বলেন, 'ভোলা বসাকের ছানার জিলাপি আর রসমালাই সবচেয়ে বেশি চলে। বসাক মিষ্টান্নের সব আইটেমই ভালো, কিন্তু ছানার জিলাপি, রসমালাই, রাঘবসাই এইগুলা বেশি ভালো হয়।' ছানার জিলাপিটি বসাক মিষ্টান্নের এক প্রকার সিগনেচার আইটেম।      

ভোলানাথ বসাকের ছোটছেলে আনন্দ কুমার বসাক মিষ্টির কারিগরি, তৈরির বিভিন্ন কায়দা-কানুন, বিক্রি-বাট্টার ব্যাপারে অনেক কথা জানালেন। মিষ্টি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার ব্যাপারে তিনি বললেন, 'মিষ্টিকে আমরা মূলত দুই ভাগে ভাগ করি – স্লো আইটেম, ফাস্ট আইটেম। যে আইটেমগুলোর চাহিদা বেশি এবং খুব তাড়াতাড়ি বিক্রি হয় সেগুলা ফাস্ট আইটেম। যেগুলার বিক্রি দেরিতে হয় সেগুলা স্লো আইটেম।' 

'মিষ্টির স্বাদে ভ্যারাইটি আনার এক্সপেরিমেন্ট আমরা প্রতিবছরই করি। কিন্তু একেবারে নতুন রকম মিষ্টি বাজারে আনলে ক্রেতা সহজে সেগুলা কিনতে চায় না। একবার কাস্টমার ধরা গেলে তখন মিষ্টিগুলা চালানো যায়।' 

আনন্দ বসাক মিষ্টান্নকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। রসজাতীয় (যেমন : রসগোল্লা, রাজভোগ, স্পঞ্জ ইত্যাদি), ভাজা মিষ্টি (যেমন : পানতোয়া, কালোজাম, ছানার জিলাপি ইত্যাদি), শুকনো মিষ্টি (যেমন: সন্দেশ, রাঘবসাই, ছানার মিষ্টি ইত্যাদি) ও দই আইটেম।  

হালুইকর বাসুচন্দ্র পাল বলেন, 'একবার আমরা কেক সুইট নামে একটা মিষ্টি বানাই। কেকের মতো স্লাইস করে কাটা থাকে। খেতে অনেকটা কাটাভোগের মতো। মোটামুটি ভালো সাড়া পাইছিলাম। তবুও আইটেমটার বিক্রি কম হইত। এখন কেক সুইট শুধু উৎসব-পার্বণের আগে বানানো হয়।' 

রাঘবসাইয়ের মণ্ড

বসাক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে প্রতিদিন ৮-১০ মণ দুধের মিষ্টি বানানো হয়। উৎসব বা ছুটির দিনে পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। জেলার বাইরেও তাদের কিছু বাঁধা খরিদ্দার আছে। ঢাকায় কুরিয়ার ও বাসযোগে নিয়মিত পার্সেল করে মিষ্টি পাঠানো হয়। আনন্দ বসাক জানান যে, এ অঞ্চলের বেশ কয়েকজন প্রবাসী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী যারা দেশ ও দেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন তারাও নিয়মিত অর্ডার দিয়ে মিষ্টি নেন। মিষ্টির সুবাদে তাদের সাথে এখনও যোগাযোগ হয়।


মোদকত্রয়ের মিষ্টান্নের দোকান

মোদক সম্প্রদায় বংশপরম্পরায় হালুইকর। শাহজাদপুরের মোদকদের মধ্যে মধুসূদন মোদকের দুই ছেলে নারায়ণচন্দ্র মোদক ও সুধীরচন্দ্র মোদক স্বাধীনতার পরপরই উপজেলা সদরে মিষ্টির দোকান চালু করেন। দুই দশক আগেও 'মোদক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার' নামে একটি দোকানে তারা ব্যবসা পরিচালনা করতেন। ২০০৪-০৫ সালের দিকে মোদক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার বিভক্ত হয়। 

নারায়ণ চন্দ্রের ছেলেরা ভাগ হয়ে 'নিউ মোদক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার' শুরু করেন। জীবন মোদক ও অচিন্ত্য মোদক এর কর্ণধার হন। বলরাম চন্দ্র মোদক শুরু করেন 'মোদক সুইটস'। মোদকের আরেকটি শো-রুম আছে যেখানে শুধু ঘি বিক্রি করা হয়।         

তিনটি মোদকে প্রায় ৩০ ধরনের মিষ্টি বানানো হয়। রাজভোগ, চমচম, রাঘবসাই, কয়েক রকম দই ও সন্দেশ, স্পঞ্জের মিষ্টি, ইলিশপেটি আরো কত কি! তবে এ আইটেমগুলোর মধ্যে মোদকের সবচেয়ে বেশি চলা আইটেমের নাম 'খুরমা'। 

এটি আরবের খোরমা-খেজুরের মতো কিছু নয়। মোদক মিষ্টান্নের একজন স্বত্বাধিকারী রামকৃষ্ণ মোদক বলেন, 'মোদকের দই আর খুরমার সুনাম সবচেয়ে বেশি। খুরমাটা সবচেয়ে বেশি চলে। অন্য মিষ্টিগুলাও ভালো চলে।'

মোদকের বিখ্যাত খুরমা, ছবি: মেহেদি হাসান/টিবিএস

মোদকে পাঁচজন মিষ্টির কারিগর আছেন। তাদের মধ্যে জয়দেব সবচেয়ে দক্ষ। রসুইঘরের কারিগররা আমাকে স্পেশাল খুরমা বানানোর প্রক্রিয়াটা বুঝিয়ে দিলেন। প্রথমে ময়দা নিয়ে কাজ শুরু হয়। পরে তার সঙ্গে কালোজিরা মিশিয়ে আরো ভালোভাবে মাখানো হয়। রুটির মতো বেলে চিকন করে দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি সাইজে কাটা হয়। পরে সেগুলো ভেজে ঠান্ডা করে রসের মধ্যে ছাড়া হয়। 

জয়দেব হালুইকর বলেন, 'রস থেকে তুলে আমরা সেগুলা শুকাতে দেই। শুকালে গায়ে চিনির আস্তরণ পড়ে। এগুলাই খুরমা। দামে কম, খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ধনী-গরীব সবাই এটি পছন্দ করে।'

নিউ মোদকের জীবন মোদককে প্রশ্ন করলাম তিন মোদকের খুরমার স্বাদ এখনও এক ও অভিন্ন কীভাবে থাকল? তিনি বললেন, 'মোদক থেকে বের হয়ে আসার সময় আমরা দুইজন কারিগরকে সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। তারা আবার কয়েকজনকে শিক্ষা দিলেন। এইভাবে মিষ্টান্ন ও খুরমার স্বাদ এখনও অটুট রাখা গেছে।'  

মোদকের দইও খুরমার মতো বিখ্যাত

খুরমার মতো মোদকের দইয়ের খ্যাতিও সর্বত্র। কাপড় ব্যবসায়ী সুলতান হোসেন বলেন, 'দই শাহজাদপুরে অনেকে বানায়। কিন্তু মোদকের মতো পারে না। মোদকের দইয়ের ওপর গাঢ়, সরের প্রলেপ পড়ে। চকলেটের মতো খেতে। হাটের দিনে আমরা পাইকাররা সবাই দল বাইধা মোদকের স্পেশাল দই-চিড়া খেতে আসি।'

মোদক সুইটসের সন্তোষ মোদক জানালেন যে তারা মিষ্টি বানানোর উদ্দেশ্যে যে দুধ নিয়ে আসে তার বড় অংশ হাড়ি দই, সরা দই, পাতিল দই, ক্ষীর দই, স্পেশাল দই, টক দই তৈরিতে খরচ হয়। মোদকের ঘিয়ের চাহিদাও দইয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। 

নিউ মোদকের বিখ্যাত ছানা ও সন্দেশ। ছবি: মেহেদি হাসান/টিবিএস

নিউ মোদকের কারিগর মোন্নাফ আলী জানায়, 'ঘিয়ের ফ্লেভার ধরে রাখার উপায় হল টাটকা সর বা ননী দিয়ে ঘি বানানো। আজকের জ্বাল দেওয়া দুধের ফ্যাট দিয়ে কালকে ঘি বানালে স্বাদ কমে যাবে। অনেকে তিন-চারদিনের সর দিয়ে একসাথে ঘি বানায়। এতে কোয়ালিটি নষ্ট হয়। মোদকে এরকম করা হয় না।'

নতুন মিষ্টি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার ব্যাপারে মোদক মিষ্টান্নের রামকৃষ্ণ মোদক বলেন, 'এই বছরের প্রথম দিকে খেজুরের গুড় দিয়ে রসগোল্লা বানিয়েছিলাম। মিষ্টিতে চিনির জায়গায় গুড়ের যথাযথ ব্যবহার নিয়ে অনেক পরীক্ষা করেছি আমরা। গুড়ের সন্দেশও সেরকম একটা আইটেম ছিল। ইলিশপেটি, দুধজামের মতো নতুন কিছু আইটেম নিয়ে এসেছি।'

তিন মোদকের প্রতিদিনকার বিক্রি-বাট্টার পরিমাণ কয়েকশ কেজি। তিনটি দোকানে প্রতিদিন প্রায় ১৫০০-১৬০০ কেজি দুধের কারিগবি চলে। মোদক থেকে প্রি অর্ডার দিয়ে মিষ্টি নেওয়া যায়। 


সাহা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার 

শাহজাদপুরে সবচেয়ে বেশি পদের মিষ্টি তৈরি করে সাহা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। প্রায় ৪০ প্রকারের মিষ্টি বিক্রি সাহা মিষ্টান্নে। পূর্বোক্ত ধরণগুলোর পাশাপাশি ল্যাংচা, মালাইকারি, পঞ্চভোগ, ক্ষীরকদম, ক্ষীর চমচম, ক্ষীরজাম, ছানার বরফি, হাফসি সন্দেশ, কমলাভোগ, খেজুর মিষ্টি, টেস্টি মিষ্টি, লোকাল সন্দেশ, মিষ্টি দই, মরিচ মিষ্টি ইত্যাদি কয়েক প্রকার মিষ্টি বানানো হয়। 

সাহা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বর্তমান মালিক মনোরঞ্জন সাহা শাহজাদপুরের প্রবীণ মিষ্টি বিক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি জানালেন, তার বাবার আমল থেকে তারা মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। '৬০ এর দশক থেকে তাদের মিষ্টির ব্যবসা।  

মনোরঞ্জন সাহা। ছবি: মেহেদি হাসান/টিবিএস

সাহা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার বর্তমানে শাহজাদপুরে এককভাবে সবচেয়ে বেশি মিষ্টি উৎপাদন করে। প্রতিদিন প্রায় ১৮-২০ মণ দুধের মিষ্টি প্রস্তুত করা হয়। ৬ জন কারিগর সবসময় কারখানায় মিষ্টি বানাতে ব্যস্ত থাকে। নতুন কোনো আইটেম বানানোর প্রয়োজন হলে বাইরে থেকে কারিগর নিয়ে আসা হয়। 

সাহা মিষ্টান্নে মিষ্টি নিয়ে প্রচুর এক্সপেরিমেন্ট করা হয়। আরেক স্বত্বাধিকারী গৌতম সাহা বলেন, 'বিক্রি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করি। মানুষ এখন জানে যে হরেক পদের মিষ্টি কিনতে হলে কার কাছে যেতে হবে। কিছুদিন আগে আমরা কারিগর এনে চকোচকো সন্দেশ ও ঝাল মিষ্টি বানিয়েছিলাম। কাস্টমারদের ভালো রেসপন্স পেয়েছি। পাটিসাপটা মিষ্টি নামে নতুন আরেকটি আইটেম বানিয়েছি।' 

এখানে ৪৫০-৫০০ টাকা কেজির হাফসি সন্দেশ, ছানার আইটেম যেমন আছে ৭০-৮০ টাকা কেজির জিলাপিও আছে।   

গৌতম সাহা আরো বলেন, 'উচ্চ আয়ের ক্রেতারা সাধারণত রাঘবসাই, সন্দেশের মতো দামি আইটেমগুলো নেয়। মধ্যম আয়ের ক্রেতারা রাজভোগ, কালোজাম, পানতোয়ার মতো আইটেমগুলো নিয়ে থাকে। আর নিম্ন আয়ের মানুষদের পছন্দের শীর্ষে চমচম, খুরমা আর জিলাপি।' 

'আমাদের সেভাবেই বানাতে হয়। ছুটির দিন, উৎসব-অনুষ্ঠান দেখে আমরা মিষ্টির আইটেমগুলো বানাই। শাহজাদপুরে মধ্যম আয়ের মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাই ঐ আইটেমগুলো ফাস্ট চলে। রবীন্দ্রজয়ন্তী, শাহ মুখদমের মেলা, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আগে আমরা মাঝারি দামি ও বেশি দামি আইটেমগুলো বেশি বানাই। দর্শনার্থীরা ঘুরে যাওয়ার সময় মিষ্টি কিনে নিয়ে যান।'

সাহা মিষ্টান্নে সবসময় বহিরাগত দর্শনার্থীর ভিড় লেগেই থাকে। তারা মিষ্টি কিনতে এসে মিষ্টি ও শাহজাদপুরের ব্যাপারে নানা ধরনের প্রশ্ন করেন। দোকানের মালিক ও কর্মচারীরা হেসে সেগুলোর উত্তর দেন। বগুড়া থেকে আলাউদ্দিন খান রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি বেড়াতে এসে সাহা মিষ্টান্নে এসেছিলেন মিষ্টি খেতে। 

নতুন আইটেম চকো রোল সন্দেশ।

তিনি আমাকে বললেন, 'একটা উপজেলা শহরে এত মিষ্টির দোকান আমি এর আগে দেখিনি। আমি কয়েকপদের মিষ্টি খেলাম। ছেলেমেয়েদের জন্য মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছি। বগুড়ার যেমন দই সেরা শাহজাদপুরের তেমনি মিষ্টি সেরা।'


পাল সুইটস

১৯৭৩ সালে অজিত কুমার পাল ভাইয়েদের সঙ্গে নিয়ে 'পাল সুইটস' শুরু করেন। মাঝে কিছুদিন দোকান বন্ধ রাখা হয়। তারপর পুনরায় নতুন উদ্যমে অজিত পাল শুরু করেন। 

পাল সুইটসের সবচেয়ে প্রচলিত আইটেম চমচম। একে স্পেশাল চমচমও বলা হয়। ৬০-৭০ টাকা কেজি চমচম সব শ্রেণির মানুষের পছন্দের শীর্ষদিকে। পালে মিষ্টি তৈরির সাথে মোট ৮ জন লোক যুক্ত। মূল কারিগর ৩ জন। 

পাল সুইটসে মিষ্টি তৈরিতে কারিগরের পাশাপাশি যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। যন্ত্র ব্যবহারে মিষ্টির গুণাগুণ অটুট থাকে কিনা প্রশ্ন করা হলে অজিত পাল মুচকি হেসে বলেন, 'মেশিনে শুধু মিষ্টির আকার দেওয়ার কাজ করা হয়। মেশিনে দেওয়া হয় বলে মিষ্টির আকার অ্যাকুরেট হয়। হাতে লেগে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও কমে।'         

কারিগদের সাথে কথা বললে তারা জানান যে শুকনো মিষ্টির কাঁচামাল অনেকটা একরকম হয়। সন্দেশ, রাঘবসাইয়ের মতো মিষ্টি গুলো তৈরির সময় প্রথমে ছানা ও চিনি একসাথে জ্বাল দিতে হয়। জ্বালের প্রথম দিকে মিশ্রণটি শক্ত হয় এবং পরে নরম হয়। মণ্ডের আকার নিলে ঠান্ডা করে পেটানো হয়। বলের সাইজে নিয়ে পেটানো হয় বিধায় শেষে সেগুলো ছোট রুটির আকারে চলে আসে।

সন্দেশে দুটো প্রলেপ এক করা হয়। রাঘবসাইয়ে পেটানোর কাজটি সেভাবে হয় না। মণ্ডটিকে ট্রে বা পিড়িতে বিছিয়ে চাকু দিয়ে চারকোণা করে কাটা হয়। সন্দেশে আলাদা করে ক্ষীর ব্যবহার করা হয় না। রাঘবসাইয়ে করা হয়। চমচমেও করা হয়। চমচমের ওপরে যে গুড়ো ছিটিয়ে দেওয়া হয় সেগুলোকে হালুইকরের ভাষায় 'মাওয়া' বা 'ড্রাই' বলে। 

মাওয়া তৈরির আলাদা একটি প্রক্রিয়া আছে। নির্দিষ্ট তাপে ও ধাপে দুধ জ্বাল করে শুকিয়ে ঠান্ডা করা হয়। সেটি শক্ত হলে হাতে ডলে গুড়ো করা হয়। সেই গুড়োগুলোই 'মাওয়া' বা 'ড্রাই'। গরমের দিনে রাঘবসাই পুরোপুরি চিনি দিয়ে তৈরি করা হয়। শীতের দিনে মিষ্টিতে ভালো মানের পাটালি গুড় ব্যবহার করা হয়। 

পাল সুইটসের বিখ্যাত চমচম। ছবি: মেহেদি হাসান/টিবিএস

পাল সুইটসে প্রতিদিন ৬-৭ মণ দুধের মিষ্টান্ন প্রস্তুত করা হয়। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত ক্রেতাদের অনেকে সরাসরি পাল সুইটসে মিষ্টি কিনতে আসেন। প্রতিদিন গড়পড়তা ৫০ কেজির মতো চমচম বিক্রি হয়। পাল সুইটসে প্রায় ১৬ রকমের মিষ্টান্ন প্রস্তুত হয়। চমচমের পাশাপাশি পালের দইও বেশ বিখ্যাত। 


বটেশ্বর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার 

শাহজাদপুরের সবচেয়ে পুরনো মিষ্টির দোকান বটেশ্বর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। প্রায় ১০০ বছরের পুরনো মিষ্টির দোকানটির প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় বটেশ্বরচন্দ্র পাল। দোকানটির বর্তমান পরিচালক কানাইলাল পালের বয়স চুয়াত্তর। তার ঠাকুরদা স্বর্গীয় বঙ্কুবিহারী পাল ছিলেন ব্রিটিশ রাজের সময়কার সেটেলমেন্টের আমিন। 

কানাইলাল পাল বলেন, 'বাবা মিষ্টির কারিগরি শিখে নিজে দোকান দিলেন। ছোটবেলায় আমি বাবার কাছ থেকে মিষ্টির কারিগরি শিখে দোকানে বসা শুরু করলাম।'

কানাইলাল পাল তার তিন ছেলেকে সাথে নিয়ে বটেশ্বর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার পরিচালনা করেন। দোকানে আলাদা কোনো কর্মচারী রাখা হয়নি। কানাইলালের তিন ছেলেরা হলেন – উত্তম পাল, তপন পাল, গোবিন্দ পাল। 

কানাইলাল পাল ও তার ছেলেরা। ছবি: মেহেদি হাসান/টিবিএস

দোকানের বেচাকেনা, কাঁচামাল আমদানি ইত্যাদি কাজগুলো দেখাশোনা করেন তপন পাল। গোবিন্দ পাল সাধারণত বাবার সাথে রসুইঘরে থাকেন। উত্তম পাল সার্বিক তত্ত্বাবধায়ন করেন। 

তপন পাল বলেন, 'আমরা বেশি দুধের কাজ করি না। মাত্র ২০-৩০ কেজি দুধের কাজ হয় এখানে। আমরা কোয়ান্টিটির চেয়ে কোয়ালিটিতে বেশি মনোযোগ দেই। ঈদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০-৪৫ কেজি দুধের কাজ হয়। মিষ্টি উৎপাদন, পরিবেশনা, বিপণন সব কাজ আমরা কয়েক ভাই মিলেই করি।'

বটেশ্বরে বর্তমানে মাত্র ছয় প্রকারের মিষ্টি বানানো হয়। রসগোল্লা, ছানার জিলাপি, সন্দেশ, চমচম, কালোজাম ও রাঘবসাই। এগুলোর মধ্যে রসগোল্লা সবচেয়ে বিখ্যাত। বটেশ্বরের রসগোল্লার সুনাম আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার মুখে মুখে। 

এ ব্যাপারে কানাইলাল বলেন, 'এক সময় শাহজাদপুরের সবচেয়ে বড় মিষ্টির দোকান ছিল এটি। অত্র অঞ্চলের বড় বড় ব্যক্তিরা এই দোকানে এসে মিষ্টি খেতেন। এখানে নিয়মিত রাজনৈতিক আড্ডা বসত। স্থানীয় ও জাতীয় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাক্ষী আমার এই দোকান।'

মিষ্টির মানের ব্যাপারে উত্তম পাল বলেন, 'আমরা এখানে যে ছানার কাজ করি সেটা পুরোপুরি বিশুদ্ধ। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের মিষ্টির দাম অন্যান্য দোকানগুলোর চেয়ে একটু বেশি। ছানার কাজ করার সময় আমাদের বুঝেই আসে না অন্যান্যরা কিভাবে এক কেজি রসগোল্লা ১২০-১৩০ টাকায় বিক্রি করে।'      

গোবিন্দ পাল বলেন, 'অনেক মানুষ এসে জিজ্ঞাসা করে আপনারা পাল হয়ে কিভাবে মিষ্টির কারিগর হলেন। পালেরা দুই ভাগে বিভক্ত – রুদ্র পাল ও কুমার পাল। মাটির কাজ করে কুমার পালেরা। আমরা রুদ্র পাল।'

বটেশ্বর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে এমন ব্যক্তি মিষ্টি খেতে বা কিনতে আসেন যারা বিগত ৬০ বছর ধরে এখান থেকে মিষ্টি কিনছেন। কানাইলাল পাল এক হাতে মিষ্টির কারিগরি করেন বলে এতদিনেও বটেশ্বরের মিষ্টির গুণগত মান ভিন্ন হয়নি। 

আব্দুল আলীম বটেশ্বর মিষ্টান্নের একজন নিয়মিত খরিদ্দার। তিনি বটেশ্বরের মিষ্টির ব্যাপারে বলেন, 'এখানকার মিষ্টির মান ভালো। কেন ভালো? কারণ, এখানে অরিজিনাল ছানার কাজ হয়। বিগত ৩০ বছর ধরে বাঁধা খামারি দুধ দেয়। আর কানাইদা খুব অভিজ্ঞ। এসব কারণেই এখানকার মিষ্টি গুণে-মানে সেরা।'

শাহজাদপুরের প্রখ্যাত নাট্য আন্দোলনকর্মী ও বিবর্তন নাট্যগোষ্ঠীর পরিচালক কাজী শওকত শাহাজাদপুরের মিষ্টান্ন শিল্পের উৎকর্ষতার পেছনে তিনটি কারণকে দায়ী করেছেন। বিশুদ্ধ কাঁচামালের পর্যাপ্ততা, ঐতিহাসিক ও ব্যবসায়িক কারণে নানা ধরনের লোকের বিচরণ, মিষ্টান্নের একটি প্রতিষ্ঠিত বাজার। 

শাহজাদপুরে ছোট-বড় অনেক জমিদার ছিল। বিভিন্ন উৎসব-পূজা-পার্বণে তারা প্রজাদের নিমন্ত্রণ করে পেটপুরে মিষ্টি খাওয়াতেন। তারা বাড়িতে পেশাদার হালুইকর রাখতেন। 

তাঁতশিল্পের প্রসার ও কাপড়ের ব্যবসার দরুণ মহাজন ও ব্যবসায়ীদের বাড়িতে সবসময় নানা রকম পার্বণ, হালখাতা লেগেই থাকত। তারা খাতক, খরিদ্দার ও শ্রমিকদের উৎসব উপলক্ষে পেটপুরে মিষ্টি খাওয়াতেন। এভাবে শাহাজাদপুরে মিষ্টান্ন শিল্পের পত্তন হয়েছে। 

শুধু কাপড়ের হাট উপলক্ষে প্রতি সপ্তাহে শাহজাদপুরে কয়েক হাজার বহিরাগত আসে। রবীন্দ্রজয়ন্তী ও শাহ মুখদমের মেলাতেও এমন হয়। তারা শাহজাদপুরের মিষ্টান্নের এক বিরাট খরিদ্দার গোষ্ঠী। তারা শাহজাদপুরের মিষ্টান্ন শিল্পের প্রসারে ভূমিকা রেখেছে। 


সূত্র: মেহেদি হাসান / https://www.tbsnews.net/bangla/ফিচার/news-details-84202

সম্পর্কিত সংবাদ

শাহজাদপুরে অটোবাইক ছিনতাই চক্রের ৬ সদস্য আটক

অপরাধ

শাহজাদপুরে অটোবাইক ছিনতাই চক্রের ৬ সদস্য আটক

সিরাজগঞ্জ শাহজাদপুরে ছিনতাই হয়ে যাওয়া দুটি অটোবাইক উদ্ধারসহ অটোবাইক ছিনতাই চক্রের ৬ সদস্যকে আটক করেছে থানা পুলিশ। সোমবার...

বেলকুচি সহ সিরাজগঞ্জে ঈদ মার্কেট জমে উঠেছে

অর্থ-বাণিজ্য

বেলকুচি সহ সিরাজগঞ্জে ঈদ মার্কেট জমে উঠেছে

চন্দন কুমার আচার্য, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিঃ ষ্টার জলসার অভিনেতা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নামে পোশাক বিক্রি হচ্ছে এবারের ঈদে...

কবিগুরুর ভাষ্কর্য ভালে পাকুড় বৃক্ষ জন্মেছে!

জানা-অজানা

কবিগুরুর ভাষ্কর্য ভালে পাকুড় বৃক্ষ জন্মেছে!

শামছুর রহমান শিশির: ঊনবিংশ শতাব্দিতে বাংলার সাহিত্য গগণে ও বিশ্ব জ্ঞান পরিমন্ডলে 'ভারস্যাটাইল জিনিয়াস' খ্যাত কবিগুরু রবী...

শাহজাদপুরে ১৪৩ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ বিতরণ

পড়াশোনা

শাহজাদপুরে ১৪৩ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ বিতরণ

নিজস্ব প্রতিনিধি: ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহার করে শ্রেণি পাঠদানের জন্য শাহজাদপুরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ বিতরণ কর...

বেলকুচিতে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে মানব-বন্ধন অনুষ্ঠিত

রাজনীতি

বেলকুচিতে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে মানব-বন্ধন অনুষ্ঠিত

চন্দন কুমার আচার্য, বেলকুচি (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দ...

যমুনার পানি বিপদসীমার ৭৩ সে.মি. উপরে, বিপাকে বানভাসিরা

সিরাজগঞ্জ জেলার সংবাদ

যমুনার পানি বিপদসীমার ৭৩ সে.মি. উপরে, বিপাকে বানভাসিরা

সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও তিস্তা...