শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪

নিজস্ব প্রতিনিধি: সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া ইউনিয়নের রাউতারা স্লুইচ গেট সংলগ্ন ১২শ’ফুট রিং বাঁধটি এ বছরও ড্রেজারের বালি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে যে কোন মুহুর্তে বন্যার পানির চাপে বাঁধটি ভেঙ্গে গিয়ে ব্যাপক ফসলহানীর আশংকায় কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। গত ২৫ বছর ধরে প্রতি বছর ৯৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই বালির বাঁধ নির্মাণ ও ২০ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ভাঙ্গণ কালীন সময়ে প্রটেকশনের নামে অসাধু একটি প্রভাবশালী চক্র সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই চক্রের সাথে খোদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা- কর্মচারী,ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতা ও অসাধু ঠিকাদাররা জড়িত রয়েছে বলে এক অভিযোগ উঠেছে। এ চক্রটি গত ২৫ বছরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অন্তত ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে ওই অভিযোগে জানা গেছে। এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান ইমাম ও এসডিই ফজলুল হক এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, এ কাজে কোন অনিয়ম-দূর্ণীতি হয়নি। সিডিউল অনুযায়ী কাজ হয়েছে। ফসল রক্ষার্থে অস্থায়ী ভাবে এ বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছে,যেহেতু এটি স্থায়ী বাঁধ নয় তাই প্রবল পানির চাপে ও অতিমাত্রার বন্যায় এটা ভাংবেই বলে তারা দাবী করেন। আজ সোমবার সকালে সরেজমিন রাউতারা স্লুইচগেট সংলগ্নরিং বাঁধটি ঘুরে দেখা যায়,পাশের খাদ থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তলোন করে বাঁধটি দায় সারা গোছের ভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে যে কোন মুহুর্তে বাঁধটি ভেঙ্গে শাহজাদপুর সহ চলনবিল অঞ্চলের বির্স্তৃণ এলাকার ফসল ডুবে কৃষকদের চরম ক্ষতি হতে পারে। খোজ নিয়ে জানা গেছে, বাঁধটি ভেঙ্গে ফসল হানীর আশংকায়এ এলাকার কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। চলনবিল অঞ্চলের সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ী থেকে তাড়াশ উপজেলার নিমাইচরা পর্যন্ত প্রায় ৫৪ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধটি স্থায়ী ভাবে মেরামতের দাবী জানিয়েছে এলাকাবাসী। এ বাঁধটি স্থায়ীভাবে সংস্কার করা হলে শাহজাদপুরসহ চলনবিলাঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হবে। বাঁধটি স্থায়ী ভাবে সংস্কার না করায় প্রতি বছর বন্যার পানির প্রবল চাপে শাহজাদপুরের রাউতারা স্লুইচগেট সংলগ্ন রিং বাঁধটির ১২শ’ ফুট এলাকা ভেঙ্গে যাচ্ছে। ফলে প্রতি বছর সরকারের প্রায় ১ কোটি টাকা করে গচ্চা যাচ্ছে। অথচ এ বাঁধটি স্থায়ী ভাবে সংস্কার করা হলে শাহজাদপুরসহ চলনবিলের ৪ লাখ ২২ হাজার ৫শ’৬০ হেক্টর এক ফসলী জমিতে ১২ মাসই বহুমাত্রিক ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এতে কৃষিনীর্ভর এ অঞ্চলের প্রায় অর্ধকোটির অধিক জনগোষ্ঠির কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। যা জাতীয় অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী ও মজবুত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে বিশিষ্ট জনরা জানিয়েছেন। জানা গেছে, চলনবিল অঞ্চলের কৃষিখাতের উন্নয়নে এক ফসলী এ সব জমিকে বহু ফসলী জমিতে রূপন্তরিত করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড গত ১৯৭৭ সালে ৪৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ি মিল্কভিটা কারখানার পশ্চিম থেকে বড়াল নদীর উত্তর পাড়ের তীর দিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার নিমাইচড়া পর্যন্ত প্রায় ৫৪ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করে। যা ১৯৮০ সালে শেষ হয়। এ বাঁধটি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল পাবনা,সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলার বিশাল চলনবিল অঞ্চলকে বন্যা নিয়ন্ত্রন,পানি নিষ্কাষন ও সেঁচ সুবিধার আওতায় এনে বছরের ১২ মাসেই বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করা। পরিকল্পনা অনুযায়ী পানি নিষ্কাষনের জন্য শাহজাদপুরের রাউতারায় একটি স্লুইচ গেট ও বিভিন্ন স্থানে ২৪টি ফার্ম ইনলেট নির্মান করা হয়। কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত বাঁধটি নির্মাণের পর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালের ভয়াবহ বন্যায় রাউতারা স্লুইচ গেটের পশ্চিম অংশসহ বিভিন্ন স্থান বন্যার পানির প্রবল চাপে ভেঙ্গে যায়। ওই সব ভাঙ্গা অংশ দিয়ে প্রতি বছর বন্যার পানি প্রবেশ করায় শাহজাদপুরসহ চলনবিলের ৪ লাখ ২২ হাজার ৫শ’৬০ হেক্টর জমির অধিকাংশ ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকে। বারবার মেরামত করেও বাঁধটির ক্রুটি দূর না হওয়ায় ১৯৯০ সালে এ প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। এ অবস্থায় বাঁধটি আরো অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এ সব ভাঙ্গা অংশ আর মেরামত না করায় তা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে বাঁধটি এ অঞ্চলের কৃষকের গলার কাঁটা ও মরণ ফাঁদে পরিণত হয়। অপর দিকে বাঁধটি থেকে কোন সুফল না আসায় ঐ বছরই পানি উন্নয়ন বোর্ড এ প্রকল্পটিকে সম্পূর্ণ রূপে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে। এরপর ১৯৯১ সাল থেকে প্রায় ২৫ বছর ধরে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড শাহজাদপুরের বাথান ল্যান্ড ও ১০ হাজার হেক্টর আবাদী জমির ইরি-বোরো ধান রক্ষার অজুহাতে প্রতি বছর রাউতারা সøুইচ গেট সংলগ্ন ভাঙ্গা অংশে অস্থায়ী ভাবে রিং বাঁধ নির্মান করে সাময়ীক ভাবে এ এলাকার ফসল রক্ষার চেষ্টা করছে। বেশ কয়েক বছর এর সুফল পাওয়া গেলেও ২০০১ সাল থেকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ,ঠিকাদার ও সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোঁর্ডের প্রকৌশলীদের সীমাহীন দূর্ণীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতি বছর ৯৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বাঁধের পাশ থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে এ বাঁধটি দায়সারা গোছের ভাবে মেরামত করা হয়। ফলে নির্মানের ১৫ দিন থেকে ১ মাসের মধ্যেই সামান্য বৃষ্টি ও বন্যার পানির চাপে তা ভেঙ্গে যায় । ফলে প্রতি বছরই এ অঞ্চলের কৃষকের ব্যাপক ফসলহানী ঘটে। মাঝখানে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতা, ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসাধু ও দূর্ণীতিবাজ প্রকৌশলীরা লাভবান হলেও গত ২৫ বছরে সরকারের প্রায় ২৪ কোটি টাকা জলে গেছে। পাউবো,বিইটিএস,ডিপিএসসি,ইপিসি ও ক্রান্তি এ্যাসোসিয়েট নামের ৫ টি সংস্থার যৌথভাবে চলনবিলাঞ্চলের ওপর করা এক জরিপ সূত্রে জানা যায়,চলনবিল অঞ্চলটি ৫ লাখ ৬৬ হাজার ১৪৬ হেক্টর এলাকা নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিকল্পনায় পড়েছে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৫২ হেক্টর। সেঁচ সুবিধার আওতায় রয়েছে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫১ হেক্টর জমি। চলনবিলে রয়েছে করতোয়া,বড়াল,নন্দকুজা,বেশানী,আত্রাই,গুমানী,গুর,ফকিরনী,শিববারনই,নাগর,ছোট যমুনা,মুসাখান,নারদ ও গদাই নামের বেশকিছু নদ - নদী। বর্ষাকালে মাছের বিচরণ ক্ষেত্র ২ লাখ ৯ হাজার ৩১৪ হেক্টর এলাকা।প্রতি বছর এখান থেকে মাছ আহরিত হয় ৬৫ হাজার ৬১৪ টন।এ অঞ্চলে মোট জনসংখ্যা ৫২ লাখ ৮৪ হাজার । এর অর্ধেকই কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল। এ অঞ্চলে ক্রমশ জনসংখ্যা বাড়তে থাকায় চাষযোগ্য জমি,বিল ও জলাশয় দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। গড়ে উঠছে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা, নির্মাণ হচ্ছে অপরিকল্পিত বাড়িঘর ও রাস্তা ঘাট । এক কালের রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমার তিন-চতুর্থাংশ,নওগাঁ মহকুমার রানীনগর ও আত্রাই থানা,পাবনা জেলার চাটমোহর,ফরিদপুর,ভাঙ্গুড়া, বেড়া, সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর,উল্লাপাড়া,রায়গঞ্জ ও তাড়াশ থানা ও বগুড়া জেলার শেরপুর,নন্দীগ্রাম থানার বেশ কিছু এলাকা জুড়ে চলনবিল অঞ্চল বিস্তৃত ছিল। বিশিষ্ট লেখক আব্দুল হামিদের ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বইতে লিখেছেন, উক্ত পরিধি ছাড়াও এক সময়ের পাবনা মহকুমার সিরাজগঞ্জ অংশের পুরোটাই চলনবিলের অর্ন্তভূক্ত ছিল। প্রতি বছর বন্যায় নদ-নদীর পানির সাথে পলি এসে চলনবিলের আবাদী জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে তাই এখানে প্রচুর পরিমানে খাদ্যশষ্য উৎপাদিত হয়। ধীরে ধীরে চলনবিলের বিস্তৃর্ণ জলাভূমিতে পলি জমে তা উর্বর চাষযোগ্য আবাদী জমিতে পরিণত হয়। ১৯১৪ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ স্থাপনের ফলে বৃহত্তর চলনবিল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া থেকে জানা যায়,পদ্মা তীরের লালপুর থানা ছাড়া নাটোর মহকুমার বাকি সব এলাকাই ছিল বিলময়। এর মধ্যে চলনবিল ছিল সব চেয়ে বড় জলাশয়। যার আয়তন ছিল প্রায় ৮শ’ বর্গমাইল। সে সময় চলনবিলের নাম শুনলেই ভয়ে গাঁ ছমছম করে উঠতো। প্রায় একশ’ বছর আগে জনবসতি এলাকা বাদে চলনবিলের জলসীমার আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের উপরে। ১৯৪০ সালে পূর্ববঙ্গ রেলওয়ের প্রচার বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘বাংলায় ভ্রমন’ বইয়ে চলনবিলের আয়তন ৪৪১ বর্গমাইল উল্লেখ করা হয়েছে। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আমলের রেভিনিউ সার্ভে নকশায় উত্তর-পশ্চিমে কলম গ্রাম,দক্ষিণ-পশ্চিমে সিধুলী,দক্ষিণে হরিপুর ও গুনাইগাছা,পূর্বে হান্ডিয়াল ও তাড়াশের মাঝ এলাকাকে চলনবিল হিসাবে দেখানো হয়েছিল। হান্ডিয়ালের পর নবীন,ছাইকোলা ও বরদানগর নামের এলাকা গুলোতে জনবসতি গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৮১৩ সালে রাজশাহীকে ভেঙ্গে মালদহ,১৮২১ সালে বগুড়া ও ১৮২৮ সালে পাবনা জেলা গঠন করা হয়। প্রতি বছর বন্যার পানির সাথে পলিমাটি জমে চলনবিলের জলরাশীর বিস্তৃতি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ায় ১৯০৯ সালে চলনবিল অঞ্চলকে আবাদযোগ্য করে গড়ে তুলতে নানা পরিকল্পনা গৃহিত হয়। এ অঞ্চলে গৃহিত পরিকল্পনার আলোকে পাবলিক ওর্য়াকস্ ডিপার্টমেন্ট পৃথক চলনবিল সাব ডিভিশন গঠন করে। সেই থেকে অদ্যাবধী চলনবিলে চলছে বহুমূখী উন্নয়ন। কিন্তু রাউতারা স্লুইচগেট সংলগ্ন রিং বাঁধটি প্রতি বছর ভেঙ্গে বন্যার পানি বাঁধ অভ্যান্তরে প্রবেশ করে ব্যাপক ফসলহানী ঘটায়। ফলে এ এলাকার হাজার হাজার কৃষকের মাথায় হাত পড়ে। ক্ষতি হয় কোটি কোটি টাকার কষ্টার্জিত ফসল। অপর দিকে বন্যার পানিতে দীর্ঘস্থায়ী ভাবে আবাদী জমি ডুবে থাকায় শাহজাদপুরের লাখ লাখ গবাদীপশুর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচা ঘাস উৎপাদন বন্ধ থাকে। ফলে শাহজাদপুরের বাথান এলাকার লাখ লাখ গরু চরম খাদ্য সংকটে পড়ে। এতে শীত মৌসুমের চেয়ে বন্যার সময় কাঁচা ঘাসের অভাবে দুধের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে। তাই এলাকাবাসী ‘পাবনা সেঁচ প্রকল্প’র অনুকরনে রাউতারা স্লুইচ গেট ও বাঘাবাড়ী থেকে নিমাইচরা পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধটি স্থায়ী ভাবে নির্মাণ ও সংস্কার করে বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণ ও পাম্পিং করে বছরের ১২ মাস বহুমুখী ফসল উৎপাদন করা সহ শাহজাদপুরের চলনবিল অঞ্চলকে বন্যার হাত থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষার জোর দাবী জানিয়েছেন ।

সম্পর্কিত সংবাদ

রাজশাহীতে সন্ত্রাসী হামলায় মুক্তিযোদ্ধা আহত

অপরাধ

রাজশাহীতে সন্ত্রাসী হামলায় মুক্তিযোদ্ধা আহত

রায়গঞ্জে স্থানীয় কৃষকদের মাঝে ক্ষোভ

রায়গঞ্জ

রায়গঞ্জে স্থানীয় কৃষকদের মাঝে ক্ষোভ

রায়গঞ্জ প্রতিনিধিঃ রায়গঞ্জে সরকারী ভাবে ধান সংগ্রহ শুরু না করায় স্থানীয় কৃষকদের মাঝে ক্ষ...