সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতাঃ ‘মেয়েটা তো কায়সার হামিদের মতো খেলে’- দর্শকদের এমন মন্তব্য জাতীয় নারী ফুটবল দলের ডিফেন্ডার আঁখি খাতুনকে নিয়ে। ম্যাচের আগে বা পরে আঁখিকে উদ্দেশ্য করে অনেকে বলেন, ‘তুমি তো কায়সার হামিদ।’ কিন্তু আঁখি তো জানেন না কায়সার হামিদ কে? একদিন আঁখি নারী দলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের কাছে জানতে চান, ‘স্যার, অনেকে আমাকে বলেন কায়সার হামিদ। কিন্তু কায়সার হামিদ কে?’ দেশের ফুটবলের অন্যতম সুপারস্টার জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক কায়সার হামিদকে আঁখি চিনবেন না এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কোচ ছোটন তার সেরা ডিফেন্ডারকে জানিয়ে দেন কায়সার হামিদ কে এবং কেমন খেলতেন। কায়সার হামিদ আর আঁখির তুলনা হয় না। কিন্তু কায়সার হামিদের খেলার ধরনের সঙ্গে সত্যিই অনেক মিল আছে আঁখির। কেমন সেটা? ‘আঁখির উচ্চতা ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। ফিজিক্যাল এই অ্যাডভান্টেজটা পুরোপুরি কাজে লাগান আঁখি। প্রতিপক্ষ আক্রমণে এলে তাদের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে লম্বা পাস দিয়ে পাল্টা আক্রমণের সুযোগ করে দেন। কর্ণার, ফ্রিকিকের সময় হেডে গোল করার জন্য আঁখি খুবই দক্ষ’- বলছিলেন গোলাম রব্বানী ছোটন। অসাধারণ ডিফেন্স করা, লম্বা পাস দিয়ে প্রতি আক্রমণ করা আর হেডে গোল দেয়ার চেষ্টা- সবকিছুর মধ্যেই অনেকে কায়সার হামিদের ছায়া দেখতে পান আঁখির মধ্যে। কখনও কায়সার হামিদকে দেখেছেন? তাকে চেনেন? ‘না। তাকে তো আমি চিনি না। কখনও দেখিনি। তবে স্যারের (কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন) কাছে কায়সার হামিদ স্যার সম্পর্কে জানার পর ফেসবুকে, ইউটিউবে সার্চ দিয়ে তাকে দেখেছি’- সিরাজগঞ্জ থেকে বলছিলেন জাতীয় নারী দলের এ ডিফেন্ডার। Akhi PM প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে অর্থ পুরস্কার নিচ্ছেন আঁখি খাতুন ১৭ বছরে পা দিয়েছেন। এই বয়সেই ফুটবল খেলে পরিবারের দিন বদলে দিয়েছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার পারকোলা গ্রামের আক্তার হোসেন ও নাছিমা বেগম দম্পতির দুই সন্তানের ছোট আঁখি। আক্তার হোসেন এক সময় তাঁতের কাজ করতেন অন্যের বাড়িতে। ছেলে নাজমুল ইসলাম ও মেয়ে আঁখিকে নিয়ে কস্টেই সংসার চালাতেন। তাঁতের কাজ আগের মতো নেই। তারপর তিনি ছেলেকে নিয়ে তরকারির ব্যবসা করতেন। ফুটবল খেলে আঁখি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যে টাকা পুরস্কার পেয়েছেন সে টাকা স্থায়ী আমানত হিসেবে রেখে এখন ভালোভাবে সংসার চালাচ্ছেন তারা। আঁখির বাবা অসুস্থ। তাই এখন আর তাকে কোন কাজ করতে দেন না আঁখি। মাও অসুস্থ। আঁখির ৭ বছরের বড় ভাই নাজমুল ইসলাম উল্লাহপাড়া আকবর আলী কলেজে অনার্সের শেষ বর্ষের ছাত্র। সংসারের খরচ, বাবা-মায়ের চিকিৎসা এবং বড় ভাইয়ের পড়াশোনা- সবকিছুই এখন আঁখির অর্জন করা টাকায়। অথচ একসময় বেশ কস্টেই দিন কাটত আক্তার হোসেনের পরিবারের। ‘আমি অনেক তৃপ্ত। কারণ, এখন আমাদের কোন কস্ট নেই। আগে আমাদের টাকা-পয়সার অভাব ছিল। মাঝেমধ্যে নানাবাড়ি থেকে আমাদের চাল-ডাল পাঠাত। এখন কারও সাহায্য লাগে না। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তিনবার টাকা পেয়েছি। একবার ১০ লাখ, আরেকবার ৩ লাখ ও আরেকবার ২ লাখ। এই ১৫ লাখ টাকা বাবা কিছু রেখেছেন ব্যাংকে, কিছু পোস্ট অফিসে। প্রয়োজন হলে সেখান থেকে টাকা উঠিয়ে তিনি কাজে লাগান। এখন সবকিছু ভালোভাবে চলছে। ভাইয়ের লেখাপড়াও চলছে নির্বিঘ্নে’- বলছিলেন আঁখি খাতুন। Akhi Land আঁখির জন্য উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক বরাদ্দকৃত জমি ২০১৭ সালে ঢাকায় সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন আঁখি। এরপর আঁখিকে শাহজাদপুর সরকারি কলেজের পাশে ৫ শতাংশ জায়গা (মৌজা : দ্বারিয়াপুর, আরএস দাগ : ১০৬২৯) বাসস্থানের জন্য উপহার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। জায়গার ওপর থাকা সরকারি একটা গুদামঘর ভেঙে সেখানে আঁখির ছবিসহ ব্যানার টানিয়ে জায়গা বরাদ্দের ঘোষণাও দিয়েছিল উপজেলা প্রশাসন। তবে সেই জায়গার কাগজপত্র এখনও পাননি আঁখি। বললেন, ‘ঐ জায়গাটা পেলে সেখানে ঘর তুলে থাকতে পারতাম। এখন আমাদের বাড়িতে আমরা ও আরও দুই চাচা থাকি। আমাদের দুই কক্ষের একটি টিনের ঘর। এক কক্ষে বাবা আর ভাই থাকেন। অন্য কক্ষে আমি আর মা। আমাকে জায়গা দেবে বলে যে ব্যানার টানানো হয়েছিল সেটা ছিঁড়ে প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে।’ আঁখি এবার বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছেন। বাফুফে ক্যাম্পে থেকেই ২০১৪ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ঐ বছরই বিকেএসপি প্রথম মেয়েদের ফুটবলে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু করেছিল। বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার আগে আঁখি পড়াশোনা করেছেন নিজ এলাকা শাহজাদপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। তার ফুটবলে আসা পারকোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হয়ে। স্কুলের সব খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন আঁখি। ১০০ ও ২০০ মিটার দৌঁড়, উচ্চলম্ফ, দীর্ঘলম্ফসহ স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সব ইভেন্টেই পুরস্কার থাকত আঁখির। সেখানেরই মজার এক অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন জাতীয় নারী ফুটবল দলের এ ডিফেন্ডার, ‘একবার আমি ১২টি পুরস্কার পেয়েছিলাম। তখন পুরস্কার হিসেবে সিরামিকের প্লেট, গ্লাস সেটসহ নানান জিনিসপত্র দেয়া হতো। বারবার পুরস্কার নিতে স্টেজে উঠছিলাম। ইউএনও স্যার বলছিলেন, ‘এরপর তুমি খেলতে আসলে পুরস্কার নেয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে আসবা। আমাদের ঘরে অনেক জিনিসপত্র আছে যা আমি খেলে পেয়েছি।’ akhi family পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ডিফেন্ডার আঁখি খাতুন সব খেলা বাদ দিয়ে ফুটবলে আসার গল্পটা আঁখির কাছেই জানা যাক, ‘আমি তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। ঐ বছরই বঙ্গমাতা ফুটবল শুরু হয়। আমাদের পারকোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সবাই যখন খেলত আমি তখন পাশে দাঁড়িয়ে দেখতাম। বল বাইরে আসলে কুড়িয়ে ভেতরে দিতাম।’ ‘সবাই খেলা শেষ করে চলে আমি কয়েকজনকে নিয়ে খেলতে নামতাম। আমাদের স্কুলের মনসুর স্যার আমাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি তো ভালো খেলো। ফুটবল খেলবে?’ আমি বললাম বাবার কাছে শুনে জানাব। বাড়িতে এসে বাবা ও ভাইকে বললাম। তারা বললেন, খেলো। তারপর খেলা শুরু করলাম। উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় মেয়েদের প্রতিযোগিতা হলে আমাকে নিত। তখন সবার মুখেমুখে আমার নাম। আমাকে অনেকে দেখতেও আসত। আমিও বেশি উৎসাহিৎ হয়ে খেলতে শুরু করলাম।’ বঙ্গমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয় টুর্নামেন্টে ঢাকায় এসেছিল রাজশাহী বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন দল। আঁখিদের পারকোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিভাগীয় পর্যায়ে গিয়ে বাদ পড়ে যায়। তারপর? ‘রাজশাহী চ্যাম্পিয়ন স্কুল দলের কোচ জহির স্যার আমাকে ঐ স্কুল দলে ঢাকা নিয়ে যান। আমরা প্রথম ম্যাচেই হেরে যাই রাঙামাটির একটি স্কুলের কাছে। এরপর রাজশাহীতে একটি ক্যাম্প হয়। সেখানে দায়িত্বে ছিলেন ছোটন স্যার। আমরা জেএফএ কাপ খেলি। সেখান থেকে বাছাই করা খেলোয়াড় নিয়ে বাফুফের ক্যাম্পে ডাকা হয় অনূর্ধ্ব-১৪ দল করতে। আমি তাজিকিস্তান সফরের দলে সুযোগ পাই। সেবার আমরা চ্যাম্পিয়ন হই। ওই টুর্নামেন্টের ফাইনালে আমি পুরো সময় খেলেছিলাম। কারণ, আনুচিং চোট পেয়েছিল। ফাইনালের আগের ম্যাচে বদলি হিসেবে এক ম্যাচ খেলে কর্ণার থেকে হেডে গোল করেছিলাম। বয়সভিত্তিক ও জাতীয় দল মিলিয়ে আমার ১৩-১৪ টি গোল আছে’- বলেন আঁখি খাতুন। Akhi MOTM সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার হাতে বাংলাদেশের নারী সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে আঁখির রয়েছে বিরাট ভূমিকা। দুটি টুর্নামেন্টেই সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন সিরাজগঞ্জের কন্যা আঁখি। ফুটবলার হওয়ার পেছনে বাবার অবদানের কথা উল্লেখ করে আঁখি বলছিলেন, ‘বাবা খুব করে চেয়েছিলেন আমি যেন ভালো ফুটবলার হই। তখন বুট ও জার্সি কেনার টাকা বাবার কাছে ছিল না। বাবা অন্যদের কাছ থেকে এগুলো এনে আমাকে দিতেন।’ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মনসুর স্যারের অবদানের কথা বলতেও ভোলেননি ‘নারী ফুটবলের কায়সার হামিদখ্যাত’ ফুটবলার আঁখি খাতুন, ‘বাবা আর স্যারের উৎসাহেই আজ আমি ফুটবলে।’ ডিফেন্ডার পজিশনে থিতু হওয়ার আগে আঁখি খাতুন সব পজিশনেই খেলেছেন, ‘আমি খেলা শুরু করি রাইট আউট পজিশনে। জেএফএ কাপে খেলি স্ট্রাইকার হিসেবে। ছোটন স্যার নিয়ে আসেন মিডফিল্ডে। এরপর পল স্যার (সাবেক টেকনিক্যাল ডাইরেক্টও পল স্মলি) আমার লং শট দেখে নিয়ে আসেন ডিফেন্সে। সাবেক গোলরক্ষক কোচ রায়ান স্যার গোলরক্ষক পজিশনেও আমাকে প্রাকটিস করাতেন। এমনও হয়েছে পল স্যার ডিফেন্সের অনুশীলনে রাখছেন, আবার রায়ান স্যার গোলরক্ষকের অনুশীলনেও রাখছেন। পরে স্যাররা মিলে নির্ধারণ করেন আমি ডিফেন্সেই খেলব।’ তথ্যসূত্রঃ জাগো নিউজ

সম্পর্কিত সংবাদ

লকড প্রোফাইল থেকে রিকোয়েস্ট আসলে সহজে ছবি দেখার উপায়

তথ্য-প্রযুক্তি

লকড প্রোফাইল থেকে রিকোয়েস্ট আসলে সহজে ছবি দেখার উপায়

সম্প্রতি একাধিক সুরক্ষার ফিচার যুক্ত হলেও, ফেসবুকে প্রোফাইলের সুরক্ষা নিয়ে চিন্তা থেকেই যায়। যদিও ব্যবহারকারীদের নিরাপত্...

ঈদের পর কত দিনের মধ্যে ছয় রোজা রাখতে হয়?

ধর্ম

ঈদের পর কত দিনের মধ্যে ছয় রোজা রাখতে হয়?

শাওয়ালের ছয় রোজা একটানা না রেখে বিরতি দিয়ে আলাদা আলাদা রাখলেও আদায় হয়ে যাবে। কেউ যদি একটানা রোজা রাখে তাতেও আদায় হয়ে যাব...

দিনাজপুরে বাঁশের ফুল থেকে চাল, হচ্ছে ভাত-পোলাও

কৃষি

দিনাজপুরে বাঁশের ফুল থেকে চাল, হচ্ছে ভাত-পোলাও

ধান থেকে উৎপাদিত চালের মতো হুবহু এই বাঁশ ফুলের চাল। ভাত, পোলাও, আটা কিংবা পায়েস সব কিছু তৈরি হচ্ছে বাঁশ ফুলের চাল থেকে।...

মোস্তাফিজকে হারাতে হবে বলে মন খারাপ ধোনিদের

খেলাধুলা

মোস্তাফিজকে হারাতে হবে বলে মন খারাপ ধোনিদের

তাই তাঁর পারফরম্যান্সে নিজেদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে চেন্নাইয়ের ব্যাটিং কোচ মাইক হাসি। আজ আবার মাঠে নামছে চেন্নাই। আজ...

শাহজাদপুরে নিষিদ্ধ থ্রি-হুইলার-বাস সংঘর্ষে মা-মেয়ে নিহত! আহত ৫

শাহজাদপুর

শাহজাদপুরে নিষিদ্ধ থ্রি-হুইলার-বাস সংঘর্ষে মা-মেয়ে নিহত! আহত ৫

সিরাজগঞ্জ শাহজাদপুরে নিষিদ্ধ থ্রি-হুইলার-বাস সংঘর্ষে মা ও মেয়ে নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় আরও ৫ জন গুরুতর আহত হয়েছে। বৃহস্পতিবা...

শাহজাদপুরে প্রতারণা মামলায় আপন ভাই ও বোনের কারাদন্ড

শাহজাদপুর

শাহজাদপুরে প্রতারণা মামলায় আপন ভাই ও বোনের কারাদন্ড

সিরাজগঞ্জ শাহজাদপুরে চাচাতো বোনের দায়ের করা প্রতারণার মামলায় আপন ভাই বোনকে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। গতসোমবার দুপ...