বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪
নিজস্ব প্রতিনিধি : ‘আর পারিনা বাহে, বয়স ওইছে, শরীলে কুলায় না, কি করমু ? না খাইয়্যা থাকলি তো কেউ খাইব্যার দিবেনা ! ভিক্ষ্যা করতি গৃন্ন্যা ওয়। শুধু প্যাটের লাইগ্যাই বুড়্যা ওইয়্যাও কাম কইরতেছি, বয়স বেশী ওইচে, বেশী কাম কইরব্যার পারিন্যা, হের লাইগ্যাই কম ট্যাকা দেয়, দুঃখ নাই-তাও যে ম্যালা লোক কাম দ্যায়-এর ল্যাগ্যাই আল্লার কাচে আজার আজার (হাজার) লাক লাক শুকরিয়্যা!’-দীর্ঘশ্বাস ফেলে এমন বক্তব্য শুধু বয়সের ভারে নুব্জ এক নারী শ্রমিকের নয়। দুঃখ কষ্টে জর্জরিত শত শত হাজার হাজার বিধবা, স্বামী পরিত্যাক্তা, সহায় সম্বলহীন, চির অবহেলিত, চির পতিত, চির অপাঙক্তেয় নারী শ্রমিকের।পুরুষের সমান কাজ করেও ন্যায্য মজুরি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ায় ওইসব হাজার হাজার নারী শ্রমিকদের বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদছে ! দেখার কেউ নেই ! পরিপূর্ণ কর্মসময়ে একটানা পরিশ্রম করেও ন্যায্য মজুরী প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার হাজার হাজার নারী শ্রমিকদের শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি না থাকলেও শুধু পেটের দায়ে দিনভর হাড়ভাঙ্গা খাটুনী আর মেহনত করে বর্তমানে দু’বেলা দু’মুঠো পুষ্টিকর খাবার যোগানোই কষ্টকর ও দূঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।একবেলা দুইবেলা কাজ করে তারা যে টাকা মজুরি হিসাবে পাচ্ছেন বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশচুম্বী উর্ধ্বগতিতে তা দিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো পরিপূর্ণ উদর পূর্তি করে পরিবার পরিজন নিয়ে আহার করা সম্ভব না হওয়ায় শাহজাদপুরের হাজার হাজার নারী শ্রমিক খেয়ে না খেয়ে মানবেতর দিনযাপন করছেন।তাদের বক্তব্যমতে ‘তেলের মাথায় তেল দেওয়ার প্রবণতা’ বর্তমানে বেশী প্রচলিত থাকায় তাদের মতো অসহয়াদের দিকে একটু সাহায্য সহযোগীতার হাত কেউ বাড়িয়ে না দেওয়ায় জীবনজীবিকার প্রশ্নে তারা রীতিমতো চোঁখে সর্ষের ফুল দেখছে। জানা গেছে,শাহজাদপুর উপজেলার ১৩ টি ইউনিয়নে কর্মরত প্রায় ১৫ সহস্রাধিক নারী শ্রমিকের সিংহভাগই প্রবলা, প্রমত্তা, প্রগলভা, সমুদ্রের যোগ্য সহচারী, রাক্ষুসী ও ভয়াল যমুনার আগ্রাসনে বার বার ঘর বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। ফলে ওইসব ভাগ্যবিড়ম্বিত অজস্র নারী শ্রমিকরা শাহজাদপুর উপজেলার বিভিন্ন রাস্তা মেরামতের কাজসহ বিভিন্ন ধরনের কাজে দিন ভিত্তিতে শ্রম দিচ্ছেন। অনেকে পূর্ণ সময়ে উপযুক্ত শ্রম দিয়েও ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না।ফলে তাদের জীবন ক্রমান্বয়ে তেঁতো হয়ে উঠেছে। শাহজাদপুর উপজেলার জামিরতা ও কৈজুরী এলাকা পরিদর্শনকালে এমন বেশ কয়েকজন দুঃস্থ নারী শ্রমিকদের সাথে এ প্রতিবেদকের আলাপ হয়।আলাপকালে মৃত ইনতাজ আলীর স্ত্রী কদবানু (৮০) জানান, বয়সের ভারে নুব্জ হলেও তাকে ভাত কাপড় দেবার কেউ নেই। তাকে মাঝে মধ্যে মাটি কাটার কাজে শ্রম দিয়ে ও চরকায় সূতা কেটে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর কাটাতে হচ্ছে। হোড়দিঘুলিয়া এলাকায় তার স্বচ্ছল সংসার ছিল,যা যমুনা ৫ বার গ্রাস করে তাকে একেবারে পথে নামিয়ে ছেড়েছে। জীবনজীবীকার প্রশ্নে কোন উপায়ান্ত, বেঁচে থাকার জন্য কোন অবলম্বন না পেয়ে তিনি নারী শ্রমিকের কাজ করে কোন রকমে প্রতিটি দিন অতিবাহিত করছেন। কৈজুরী এলাকার আমছেরের স্ত্রী শেফালী (৫০) বলেন,তাকে তার পরিবারের ৫ জন সদস্যের আহার জোটাতে শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে। মাটি কাটার কাজ করে তিনি দিনে আয় করছেন ৭০ থেকে ৮০ টাকা। ধীতপুর এলাকায় তার বাড়িটি রাক্ষুসী যমুনা গিলে খেয়েছে। এজন্য খেয়ে না খেয়ে অতিকষ্টে কোন মতো তার দিন কাটছে। সোনাতুনীর (বর্তমানে যমুনাগর্ভে বিলীন) আনছের মিয়ার স্ত্রী বুলি(৪০)র বাড়িঘর যমুনার কড়াল গ্রাসে চলে যাওয়ায় ৬ জনের সংসার তাকেই চালাতে হচ্ছে। তার স্বল্প আয়ে কিভাবে ৬ জনের ভরণপোষন চলছে ?-এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়েছেন,আল্লাহপাক চালিয়ে নেন, তাই খেয়ে না খেয়ে কোন রকমে দিন চলে যাচ্ছে। উল্টাডাব গ্রামের মেনহাজ শেখের স্ত্রী খোদেজা (৫৫)কে ১২ জনের সংসার চালাতে হচ্ছে। যৎসামান্য মজুরিতে ওই বিশাল সদস্যবিশিষ্ট পরিবাবের আহার যোগান দিতে তিনি অথৈ সাগরে ভাসছেন,কোন কূল কিনারা পাচ্ছেন না। যমুনায় দুইবার বাড়িঘর বিলীন হওয়া সাহেবপাড়ার মৃত সুলতান মোল্লার স্ত্রী মমতা (৫০) মহিলা হয়েও ৯ জনের সংসার চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। ৯ জনের খাবারের অর্থ যোগান দেওয়া যে কতটা যে কষ্টকর তার প্রকৃষ্ট ও জ্বাজল্য দৃষ্টান্ত বাস্তবে না দেখলে বোঝার কোন উপায় নেই। রাবেয়া (৬০)র স্বামী খালেক অসুস্থ ও কর্মহীন।এজন্য ৩ জনের সংসার চালনার জন্য তাকে একাই শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে। কখনো চরকায় সূতা কাটা আবার কখনো মাটিকাটা শ্রমিকের কাজ করে তিনি দিনে যা আয় করছেন তা দিয়ে দুইবেলা উদরপূর্তি করে ডাল-ভাত খাওয়াই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। মৃত মুইচ্যার স্ত্রী লুবজান (৫০) বারে বারে যমুনার ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন। দিনে যা আয় হয় তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে তার পরিবারের দিন কাটে। কোনদিন কাজ বন্ধ থাকলে বাধ্য হয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয় তাকে ও পরিবারের সদস্যদেরকে। আনোয়ারের স্ত্রী আনোয়ারা (৫০) আগে মাকড়া গ্রামে বেশ স্বচ্ছলভাবে দিন কাটিয়েছেন। রাক্ষুসী যমুনা তার সব স্বপ্ন ধুলিস্মাত করে দিয়েছে। ৫ বার যমুনা তার বাড়ি গ্রাস করেছে। তিনি শ্রমিকের কাজ করে মানবেতর দিনযাপন করছেন। ইনসাফ আলীর স্ত্রী বেলা খাতুন (৩০) অতিকষ্টে পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর দিনাতিপাত করছেন। ৪ বার তার বাড়ী যমুনায় ভেঙ্গে যাওয়ায় বর্তমানে তিনি নিঃস্ব ও স্বর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন। আনোয়ারের স্ত্রী সেলিনা (২০)কে যমুনায় ভাঙ্গনজনিত কারনে পরিস্থিতি কোমড়ে টুপরি তুলে দিতে বাধ্য করেছে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আর মেহনত করে আয় করছেন মাত্র ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এ টাকা দিয়ে খাওয়া দাওয়া করাই অতি কষ্টকর বলে তিনি জানিয়েছেন। মৃত আরশেদ আলীর স্ত্রী বানু (৭৫) মহিলা হয়েও নারী শ্রমিকের কাজ করে ৬ জনের সংসার খুব কষ্টে চালাচ্ছেন । আগ্রাসী যমুনা ৪ বার তার বাড়িঘর গ্রাস করেছে। বর্তমানে তিনি নিঃস্ব ও সর্বশান্ত। ৩ বার সাহেবপাড়া এলাকায় মৃত কুরানের স্ত্রী আয়শা(৫৫)র বাড়ি যমুনায় বিলীন হওয়ায় তিনি নারী শ্রমিকের কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। মৃত ঈমান আলীর স্ত্রী তারা বানু(৮০)র দুঃখের অন্ত নেই। শরীরে না কুলানোয় বর্তমানে তিনি কাজ করতে না পারায় চেয়েচিন্তে কোন রকমে প্রতিটি দিন প্রতিটি ক্ষণ অতিবাহিত করছেন। মৃত হানিফের স্ত্রী সুফিয়া(৬০) ও যমুনায় বিলীন হয়ে যাওয়া আলমগীরের স্ত্রী তাছলিমা (২০),খোশাল শেখের স্ত্রী সরবানু(৮০)র সোনার সংসার প্রবলা যমুনা ৬ বার ভেঙ্গে দিয়েছে। সোরহাব আলীর স্ত্রী শাহীনুর(৬০)-এর বাড়ি দাদপুরে থাকলেও ২বার যমুনা তা গ্রাস করেছে। রমজানের মেয়ে আনজিরা (৪৮),ইয়াছিনের স্ত্রী রিজিয়া(৭০),মৃত মোসলেমের স্ত্রী মনোয়ারা(৪০),বাবলুর স্ত্রী মনোয়ারা(২৫)সহ হাজার হাজার নারী অসহায় হয়ে নারী শ্রমিকের কাজে সম্পৃক্ত হতে বাধ্য হয়েছেন। প্রতিটি দিনে বেঁচে থাকার মতো আহারের যোগানের চিন্তা ছাড়া অন্য কোন ভাবনা ভাববার কোন সময় নেই তাদের । কাজ করলে একবেলা আধবেলা পেটের ভাত জোটে ,আর কাজ না করতে পারলে তাদের খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। সহায় সম্বলহীন ওইসব হাজার হাজার হৎদরিদ্র নারী শ্রমিকের খোঁজখবর কখনো নেয়না কেউ । উপযুক্ত শ্রম দিয়েও ন্যায্য মজুরি না পেয়ে ওইসব ভাগ্যবিড়ম্বিত হাজার হাজার নারী শ্রমিকেরা তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারছেন না। চরম অর্থাভাবে পেটপুরে পুষ্টিকর খাবারের যোগান দিতে না পেয়ে তারা প্রতিনিয়ত পুষ্টিহীনতায় ভূগছে। অর্থাভাবে তাদের সুচিকিৎসাও হচ্ছে না। সামনে নেই তাদের কোন ভবিষ্যত। শুধুই নেই ,নেই, নেই আর নেই! এমনি কদবানু (৮০),সরবানু(৮০),তারা বানু (৮০) নয়, তাদের মতো শাহজাদপুরের নাছিমা, আসমা, আলো, আলেয়া, আছিয়া, জহুরা, সোনেকা, জয়তুন বেওয়া, কোহিনূর, ছালেহাসহ হাজার হাজার নারী শ্রমিকদের দিনে মাটি কাটাসহ বিভিন্ন কাজে শ্রম দিয়েও ন্যায্য মজুরি না পেয়ে খেয়ে না খেয়ে অতিকষ্টে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর দিনযাপন করতে হচ্ছে। শাহজাদপুরের ওইসব হতভাগা হাজার হাজার নারী শ্রমিকেরা নায্য মজুরি না পেয়ে বাউল সংগীত শিল্পী কাঙ্গালীনি সুফিয়া খাতুনের অলোড়িত গান ‘কত কষ্ট কইর‌্যা আমি,ইট্যা দিয়্যা পাথর ভাঙ্গি,মাথার ঘাম পায়ে ফেলি,তবু দুঃখ গেলো---নারে! বান্ধব বুড়ি হইলাম তোর কারনে!’- এর মতোই নীরবে নিভৃতে অবিরত অজস্র বারি ঝড়িয়ে আক্ষেপ প্রকাশ ও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, হাঁহুতাশ করে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর দিনযাপন করছেন।

সম্পর্কিত সংবাদ

শাহজাদপুরে মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশারের নামে সড়কের নামকরণ’র উদ্বোধন

শাহজাদপুর

শাহজাদপুরে মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশারের নামে সড়কের নামকরণ’র উদ্বোধন

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে শাহজাদপুর সংবাদ ডটকম এর প্রধান সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার-এর নামে সড়ক নামকরণের উদ্বোধন...

এইডস আতঙ্কের ব্যাপ্তি, প্রতিরোধেই মিলবে মুক্তি

সম্পাদকীয়

এইডস আতঙ্কের ব্যাপ্তি, প্রতিরোধেই মিলবে মুক্তি

লাইট হাউস শাহজাদপুর ডিআইসি আয়েজিত প্রজেক্ট ফ্যসিলিটেশন টিমের ২০১৫ সালের ১ম সভায় উপস্থাপি...