শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
শামছুর রহমান শিশির ও জহুরুল ইসলাম: অবৈধ দখলের মাধ্যমে কালাবর্তনে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে বিভিন্ন নদীর অস্তিত্বকে । তেমনি অবৈধ দখলদার আর প্রভাবশালীদের করায়াত্বে আটকা পড়ে বড়াল নদী বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। শাহজাদপুর উপজেলার বুকের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বেশ কয়েকটি নদী। তন্মদ্ধে বড়াল নদীটি বেশ বড় ও অধিক জনগুরুত্বপূর্ণ । করতোয়া, বড়াল হুরাসাগরের মিলনস্থল সংলগ্ন বড়াল নদীতে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বাঘাবাড়ী নৌ-বন্দরের অবস্থান। বাঘাবাড়ী নৌ-বন্দরটি মূলতঃ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিস্থল । ওই নৌ-বন্দরের জেটিঘাটগুলোও বড়াল নদীর তীরে নির্মিত। বাঘাবাড়ী নৌ-বন্দর থেকে উত্তরের ১৬ জেলায় সব ধরনের জ্বালানী তেল, সার, কয়লা, চালসহ বিভিন্ন মালামাল পরিবাহিত হয়ে থাকে যা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নৌ-পথে বড়ালের বুকের ওপর অবস্থিত বাঘাবাড়ী নৌ-বন্দরে এসে থাকে। সেইসাথে, বড়াল নদীটি বৃহত্তর চলনবিল অঞ্চলের সেঁচকার্য, মৎস্যখাত, গবাদী শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে রাখে অপরিসীম অবদান। অথচ দখল, দূষণ আর সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় দখলে দখলে দিনে দিনে সংকীর্ণ হয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে নদীটি। কালের আবর্তনে সময়ের পরিধিতে ক্রমেই এ নদীর দু'কূল অবৈধ দখলদারদের করায়াত্বে চলে যাচ্ছে ও নদীর দু'কূলে গড়ে উঠছে নানা অবৈধ স্থাপনা, কলকারখানা ও ঘরবাড়ি । বিভিন্ন স্থানে বড়ালের তীর দখল করে বালি ফেলে ভরাট করে দখল উৎসবে মেতে উঠেছে বেশ কিছু স্বার্থান্বেষী ও প্রভাবশালী মহল। ফলে অতীব জনগুরুত্বপূর্ণ এক সময়ের প্রবলা, প্রমত্তা, প্রগলভা, উত্তাল বড়ালের পানি প্রবাহ এলাকা দিনে দিনে কমে নদীটি ক্রমান্বয়ে সংকীর্ণ আকার ধারন করছে। এছাড়া, উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বাঘাবাড়ী নৌ- বন্দরের বড়াল নদীর দক্ষিণাংশের বিভিন্ন স্থান অবৈধ দখলদারদের করায়াত্বে চলে যাওয়ায় দিনে দিনে বাঘাবাড়ী নৌ-বন্দরের নৌ-চ্যানেলটিও হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে। বিজ্ঞমহলের মতে, 'বড়ালের অস্তিত্ব রক্ষায় ও বাঘাবাড়ী নৌ-বন্দরের নৌ-চ্যানেল সচল, সুরক্ষায় অবিলম্বে যথাযথ উদ্যোগ ও কার্যকর ব্যাবস্থাগ্রহণ করা না হলে অচিরেই শাহজাদপুরসহ উত্তর জনপদের মানুষ অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির কবলে পড়বে যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।' তথ্যানুসন্ধানে, এলাকাবাসীসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাঘাবাড়ী নৌ-বন্দর সংলগ্ন বড়াল নদীর দক্ষিণাংশে দেশবন্ধু সিমেন্ট মিলস্ লিঃ এর বৃহৎ কারখানা নির্মাণ করে সিমেন্ট প্রস্তুত করা হচ্ছে। ওই সিমেন্ট কারখানাটি দূর থেকে জাহাজের মতো পরিলক্ষিত হচ্ছে। বড়াল নদীর ৯.৭২ একর জমিতে নির্মিত হয়েছে দেশবন্ধু গ্রুপের সিমেন্ট কারখানা। বগুড়া-নগরবাড়ী মহাসড়কের শাহজাদপুর অংশের বড়াল সেতু পাড় হয়ে বাঘাবাড়ী দক্ষিণ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন স্থান থেকে নদী ঘেঁষে পূর্ব দিকে চলে গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মিত 'মুজিব বাঁধ' নামক একটি পাকা সড়ক। এ সড়কের পূর্বদিকে সামান্য এগুলেই হাতের বাম পাশে পরিলক্ষিত হয় দেশবন্ধু সিমেন্ট কারখানা। কারখানাটি নদীর তীরে নির্মিত হওয়ায় উত্তর পাড় থেকে কারখানাটিকে ভাসমান একটি জাহাজের মতো মনে হয়। বড়াল নদীর তীরে ২.৯০ একর জমিতে মূল কারখানার নির্মিত হলেও কারখানার পরিধি বৃদ্ধিতে নদী তীরের আরও ৬.৮২ একর জমিতে মাটি ভরাট করে স্থায়ী সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেছে সংশ্লিষ্টরা। নদীর তীর ভরাটের ফলে নদীর প্রকৃত গতি প্রকৃতি বিকৃত, নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে ও নৌ-বন্দরের নৌ-চ্যানেল ক্রমেই সংকীর্ণ আকার ধারণ করায় নৌ-বন্দরে আসা কার্গো জাহাজের স্বাভাবিক চলাচলও বাধাগ্রস্থের শংকা তৈরি হয়েছে। দখল হয়ে যাওয়া বড়ালের তীর দ্রুত উদ্ধার ও দখল মুক্ত না করলে ভবিষ্যতে বাঘাবাড়ী নৌ-বন্দর হুমকিতে পতিত হবে। শাহজাদপুর ভূমি অফিস হতে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বিগত সিএস জরিপে যতটুকু জায়গা বড়াল নদীর অন্তর্গত ছিল, পরবর্তীতে এসএ জরিপে তা তিন খন্ডে বিভক্ত হয়। তন্মদ্ধে, একাংশ বালুচর ও কিছু অংশ ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ডভূক্ত হয়। দেশ স্বাধীনের পরে মুজিব বাঁধ নির্মাণের জন্য ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ডভূক্ত ওই জমির বৃহৎ অংশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃক অধিগ্রহণের ফলে আরএস জরিপে ব্যাক্তিমালিকানায় রেকর্ডভূক্ত জমির বৃহৎ অংশ পাউবো'র আওতাভূক্ত ও কিছু জমি ব্যাক্তি মালিকানার জমি হিসেবে রেকর্ডভূক্ত হয়। আরএস ভূমি জরিপে ব্যাক্তি মালিকানায় রেকর্ডভূক্ত জমির বিরুদ্ধে রেকর্ড সংশোধনের জন্য দেওয়ানী আদালতে একটি মামলা হয়। এর মধ্যেও দেশবন্ধু সিমেন্ট কারখানার কার্যক্রম চলমান থাকে। গত ২০১৬ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মোঃ আতাহারুল ইসলাম বড়াল নদী পরিদর্শণে বাঘাবাড়ী আসেন। পরিদর্শন শেষে কমিশন কর্তৃক পেশকৃত এক প্রতিবেদনে দেশবন্ধু সিমেন্ট কারখানাটি সম্পূর্ণ বড়াল নদীর অন্তর্গত জমির ওপর নির্মবত মর্মে উল্লেখ করাসহ নদীর সীমানা নির্ধারণপূর্বক বড়াল নদীকে দখলমুক্ত করতে নদীর তীরে গড়ে ওঠা সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সুপারিশ করা হয়। সেইসাথে বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে দেশবন্ধু সিমেন্ট কারখানার বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের হয়। সম্প্রতি, বিজ্ঞ আদালত সিএস নকশা অনুযায়ী বড়াল নদীর প্রকৃত গতি প্রকৃতি রক্ষা ও স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ নিঃশ্চিতে নদীর তীরে ব্যাঙ্গের ছাতার গড়ে ওঠা সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন । এ বিষয়ে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাহ মো: শামসুজ্জোহা সাংবাদিকদের জানান, 'বড়াল নদী তীরের জমি দখল করে দেশবন্ধু সিমেন্ট কারখানা নির্মাণের অভিযোগে বিজ্ঞ আদালতে ইতিপূর্বে মামলা হয়েছিলো। বিজ্ঞ আদালত সিএস নকশা অনুযায়ী নদীর স্বাভাবিক গতি প্রকৃতি ও স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠনপূর্বক কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখে বড়াল নদীর সীমানা নির্ধারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। ইতিমধ্যেই নদী রক্ষা কমিশন বরাবর সার্ভেয়ার নিয়োগের আবেদন করা হয়েছে। সার্ভেয়ার নিয়োগকার্য সম্পন্ন হলেই বড়াল নদী রক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে।' অপরদিকে, বড়াল নদীর অস্তিত্ব ও বাঘাবাড়ি নৌ-বন্দরের নৌ-চ্যানেল সুরক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছে এলাকাবাসী।

সম্পর্কিত সংবাদ

শাহজাদপুরে আবাসিক হোটেল ব্যবসার করুন অবস্থা, প্রনোদনা চায় ব্যবসায়ীরা

অর্থ-বাণিজ্য

শাহজাদপুরে আবাসিক হোটেল ব্যবসার করুন অবস্থা, প্রনোদনা চায় ব্যবসায়ীরা

এ বছরের ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া টানা একমাসের লকডাউনে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের আবাসিক হোটেলগুলো ফাকা পড়ে আছে। স্টাফ বেতন,...

শাহজাদপুরে দুই মেয়েকে বিষ পান করিয়ে মায়ের আত্মহত্যা

শাহজাদপুর

শাহজাদপুরে দুই মেয়েকে বিষ পান করিয়ে মায়ের আত্মহত্যা

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের ইসলামপুর ডায়া নতুনপাড়া গ্রামে স্বামীর সাথে ঝগড়া করে বিষপান করে ম...

শাহজাদপুরের বাঘাবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ!

অর্থ-বাণিজ্য

শাহজাদপুরের বাঘাবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ!

এম এ হান্নান শেখঃ সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের পূর্ব পাশে অবস্থিত পিডিবির ৩টি ও বেসরকারি ১টি মিলে মো...