রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪
elis (8)_248339image_852_245918 আবুল বাশার : বাংলা নববর্ষ সম্রাট আকবর চালু করেছিলেন রাজস্ব আদায়ের জন্য। এর সঙ্গে যতই উৎসব আনুষ্ঠানিকতা থাক, মূলে ছিল অর্থনীতি। দেশে দাপ্তরিক কাজে এখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার এবং বাংলা পঞ্জিকা দুটোই ব্যবহৃত হচ্ছে। নববর্ষের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সূত্রেই দেখি, জমিদারি প্রথা যতদিন চালু ছিল, ততোদিন বাংলা নববর্ষ পুণ্যাহ হিসেবে পালিত হতো। জমিদারি প্রথা বিলোপ হয়ে গেলেও এখনও পয়লা বৈশাখ থেকেই সরকারি জমিজমা ইজারার পত্তন শুরু হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যে ওই দিনেই নতুন বছরের জন্য হালখাতা খোলা হয়। এ কারনে কৃষক ও শ্রমজীবি মানুষের কাছে ১ লা বৈশাখ অতীতেও যে খুব আনন্দের দিন ছিল তেমনটা নয়। এই ১ হেলা বৈশাখে সকল দায়দেনা পরিশোধ করতে গিয়ে কৃষক ও শ্রমজীবি মানুষকে আনেকদিন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষপটে বাঙালি সংস্কৃতির সাথে যে পান্তা ইলিশ যোগ করা হয়েছে এর সাথে বাঙালির মূল সংস্কৃতির ধারক বাহক কৃষক ও শ্রমজীবি মানুষের কোন সম্পর্ক নেই। চৈত্রের খরতাপে কৃষকেরা মাঠে লাঙ্গল চালিয়ে একপ্রহর বেলায় ঘড়ে ফিরে শুকনো অথবা কাঁচা মরিচ ও লবন দিয়ে চিটকিয়ে খকনও সাথে পিয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত এখনও খায় । আর এই পান্তাভাত খাওয়াটা গ্রামগঞ্জের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের খাদ্য সংস্কৃতি। মাটির হাড়িতে আউশ আমন ধানের চাউলের ভাত রান্না করে রাতের খাবার শেষে অবশিষ্ট ভাত একই হাড়িতে পানি দিয়ে রেখে পরেরদিন সকালে মাটির সানকিতে (মাটির থালা) সেই পান্তা ভাত খাওয়ার মজাটা শুধুমাত্র গ্রামগঞ্জের খেটেখাওয়া মানুষই ধারন করে । শুধুমাত্র ১ হেলা বৈশাখে নয় গরমের কয়েক মাস পান্তা আর শীতের দিনে করকরা ভাতের সংস্কৃতির সাথে ইলিশের যে কোন সম্পর্ক নেই এটা আমরা ভুলতেই বসেছি। ইলিশ মাছ এখনও যেমন ষাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে রয়েছে তেমনি আতীতেও এ মাছ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে ছিল। কালে ভদ্রে গ্রামের কেউ হাটে গিয়ে ইলিশ মাছ কিনে মাছের কলশায় কলার ডাগুরের ফাতরা (রশি) বেঁধে আংগুলে ঝুলিয়ে মেঠোপথে হেটে কোন কৃষক কিম্বা ষাধারন মানুষ বাড়ী ফিরতেন পথে পথে মাছের মূল্য কত ? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সেই ক্রেতার মুখে ফেনা উঠে যেত। 2_88408 বর্তমান শতকে ষাটের দশক থেকে বাংলা নববর্ষ এক নতুন রাজনৈতিক মাত্রা লাভ করেছে। আর কোন দেশে কোন ঋতু এরকম রাজনৈতিক মাত্রা লাভ করেছে বলে জানা নেই।তবে বাংলাদেশে ৮০’র দশকে এসে শহুরে নব্য ধনীদের মাঝে যোগ হয়ে পান্তা-ইলিশ সংস্কৃতি। শহরের এই ধরনের ধনীক শ্রেণীর মানুষগুলো প্রতি বছর ১ হেলা বৈশাখের নামে পান্তা-ইলিশের সংস্কৃতি পালনের মধ্যদিয়ে গরীব মানুষগুলোকে উপহাস করছে। গত কয়েক দিনের পত্রিকার পাতাগুলোর খবরে জানতে পারি, ১০০ মন কাঁচা মরিচ বিক্রি করেও ১ টি ইলিশ মিলছে না।মানিকগঞ্জে এবার মরিচের ভালো ফলন হলেও কৃষকদের মাঝে বিরাজ করছে চরম হতাশা। প্রতি কেজি মরিচ উৎপাদন খরচ ১৪ টাকা থেকে ১৬ টাকা হলেও কৃষকরা কেউ কেউ প্রতি কেজি ১ টাকা আবার কেউ কেউ কেজিতে টাকাই পাচ্ছেন না। 14770_1 রঘুনাথপুর গ্রমের মরিচ চাষী মোঃ শাহজাহান বলেছেন আমি ১০০ কেজি মরিচ বাজারে বিক্রি করে ৬০০টাকা পেয়েছি। তোলা বাবদ ৪০০টাকা এবং ভ্যান ভাড়া বাবদ ১০০ টাকা দিয়েছি। ১০ কেজি মরিচ বিক্রি করে আমি ১০০ টাকা পেয়েছি। এই ১০০ কেজি মরিচে আমার লোকসান হয়েছে ১১০০ টাকা। সামনেই ১ বৈশাখের উৎসব কিন্তু একজন কৃষক কিভাবে সন্তানাদি নিয়ে উৎসব করবে। তিনি প্রশ্ন করেন পান্তা-ইলিশ খাবো ,জানেন একটি ইলিশের দাম কত? মানিকগঞ্জ শহরের মাছ ব্যবসায়ী মোঃ শাহীন আলম জানিয়েছেন পদ্মার ১ কেজি ১টি ইলিশের দাম মোটামুটি ৪০০০ টাকা। তার হিসেবে ১টি ইলিশ কিনতে হলে ১০০ মন মরিচ বিক্রি করতে হয়। ১৩ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি পত্রিকার প্রকাশিত খবরে জানা গেছে,পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার আলীনগর এলাকার রাজারহাট বাজারে রোববার সকালে তিন কেজি ওজনের একটি ইলিশ ১৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ লোভনীয় ইলিশ মাছটি কেনার জন্য বাজারে সকাল থেকে ক্রেতাদের মাঝে রীতিমতো নিলামডাকের মতো দাম বাড়তে থাকে।এর পর মাছটিকে ঘিরে চলতে থাকে ক্রেতাদের মধ্যে দর কষাকষি। একপর্যায়ে বাজারের পাশের সুমন আহম্মেদ নামের এক ক্রেতা মাছটির দাম বলেন ১৩ হাজার টাকা। কোনো ক্রেতা এর ওপর দাম না বলায় এ দামেই বিক্রি হয়ে যায় মাছটি। সকাল থেকেই এ ইলিশ মাছটিকে ঘিরে উৎসুক ক্রেতার মাঝে চলে আলোচনার ঝড়। এ ব্যাপারে ক্রেতা সুমন আহম্মেদ বলেছেন, সামনে পহেলা বৈশাখ তাই এ মাছটি অনেক যুদ্ধ করে কিনতে হল। কারণ শখের মূল্য লাখ টাকার উপরে। একই দিনে আরেকটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে যানাযয়,শহুরে কিছু মানুষের ধারনা জন্মেছে যে,বাঙালির প্রাণের উৎসব বৈশাখ। বর্ষবরণের এ দিনে পান্তা-ইলিশ না হলে পুরো আয়োজনটাই যেন মাটি হয়ে যায়। এ সুযোগে ইলিশকে আকাশে তুলে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ইলিশ এখন আকাশের চাঁদ! ইচ্ছে করলেই একে ছোঁয়া যায় না। রোববার লৌহজংয়ের মাওয়ায় দুই কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের প্রতিটি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৮ হাজার টাকায়। বর্তমানে এক মণ ধানের দাম ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকা। সে হিসাবে দশ মণ ধান দিলে পাওয়া যাবে একটি ইলিশ। তবে বাজার ভেদে এই দামের হেরফের হয়েছে। মূলত নাটাই ছিল ব্যবসায়ীদের হাতে। তাদের হাঁকানো দামেই কিনতে বাধ্য হয়েছে ক্রেতারা। অনেক ক্রেতাই ইলিশ কিনতে না পেরে পুঁটি আর তেলাপিয়া মাছ কিনে বাড়ি ফিরেছেন। বৈশাখের সংস্কৃতিকে ঘিড়ে শহরের কিছু হিপোক্রেট গরমভাতে পানি ঢেলে কৃত্রিম পান্তা বানিয়ে ইলিশ সহযোগে তা গিলতে শুরু করলেন এবং এটিকে আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গে পরিণত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হলেন। ভাবতে অবাক লাগে যে ইলিশ এখন মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে, তা কি করে উৎসবের সার্বজনীন উপাদান হতে পারে? তাছাড়া ইলিশ কখনোই পুরো দেশ জুড়ে পর্যাপ্ত ছিল না, এটি দক্ষিণাঞ্চলের সীমিত কয়েকটি জেলায় পাওয়া যায়। গরিবদের প্রতি এই উপহাস নিরোধ করার জন্য ইলিশ দিয়ে পান্তা খাওয়ার চল নিরুৎসাহিতকরণ আবশ্যক। পহেলা বৈশাখে আর পান্তা ইলিশ নয়------মাছ আর গরম ভাতে মুখরিত হউক আমাদের আনন্দের দিনটি। এ দিনটি যেমন আমাদের বহু কাঙ্ক্ষিত আবার এরকম বহু দিনই বাংলার খেটে খাওয়া অভুক্ত মানুষের কাছে কিছুই না। বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে অসংখ্য অভুক্ত মানুষ এখনো দিন গোনে ভালো একটু খাবারের আশায়। অনেক সময় তথাকথিত ধনীর দুলালদের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্টে খোঁজে ভালো খাবারের ঘ্রাণ। কেইবা খোঁজ রাখে এসব মানুষের। হয়তো-বা ধারে-কাছে গেলেও দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় অন্যরা। পান্তা-ইলিশে নাক ডোবাবে পুরো বাংলাদেশ। ইলিশের দাম যা-ই হোক না কেন খেতেই হবে এই একটা দিন। আর সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা, ভর্তা। কিন্তু প্রতিটা দিন যাদের কাটে পান্তা-মরিচে নাক ডুবিয়ে, তাদের অচ্ছুত ভাবার রেওয়াজ কি আদৌ বন্ধ হবে? তাদের তো ইলিশ কেনা দূরে থাক, গন্ধ শোঁকারও অধিকার আজকাল হয় না। বন্ধ হবে কি সারা বছর বিদেশি সংস্কৃতিকে লালন করে এই একদিনের বাঙালি সেজে কাকের ময়ূরের পাখা লাগানোর মতো দুরাশা? তাই আসুন, প্রাণের উৎসবের পাশাপাশি, সেই সব মানুষের জন্য কিছু করার অভিপ্রায়ে প্রাণ বাঁধি সব প্রাণে। একটা দিন না হয় ইলিশ কমই খাওয়া হলো। সেই দামে না হয় কিছু না-খাওয়া মানুষকে খেতে দিই, কিছু কর্মসংস্থানের অঙ্গীকার করি। নতুন সংকল্প হৃদয়ে ধারণ করি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা চাইলে অনেক কিছুই সম্ভব। আমরা পারি। আমরা মাথা নোয়ানো জাতি নই। আমরা প্রমাণ করেছি সে কথা বহুবার, তা ইতিহাস জানে।ভাবতে ভালো লাগে, সত্যিকারের সোনার বাংলা, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত একটি সকাল। এ আমার, আপনার সবারই প্রাণের কথা। সত্যিকারের সোনার বাংলা হাতছানি দেয়, আসুন না, সে ডাকে সাড়া দিয়ে যাই প্রাণের টানে প্রাণের উৎসবে।

সম্পর্কিত সংবাদ

শাহজাদপুরের সাবেক এমপি কবিতা ও চয়নের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা

রাজনীতি

শাহজাদপুরের সাবেক এমপি কবিতা ও চয়নের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর আসনের সাবেক দুই সংসদ সদস্যসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা হয়েছে। ঘটনার দুই বছর পর বৃহস্পতিব...

নানা অব্যবস্থাপণায় চলছে পাবনা সেচ প্রকল্প

নানা অব্যবস্থাপণায় চলছে পাবনা সেচ প্রকল্প

পাবনা প্রতিনিধি :-নানা অব্যবস্থাপণার মধ্যদিয়ে চালু রয়েছে পবনা সেচ প্রকল্প। অবহেলা ও অনিয়মের কারণে সেচ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ...

শাহজাদপুরে ওয়াজ শুনে বাড়ি ফেরার পথে সড়কে প্রাণ গেল শিশু হোসাইনের

শাহজাদপুর

শাহজাদপুরে ওয়াজ শুনে বাড়ি ফেরার পথে সড়কে প্রাণ গেল শিশু হোসাইনের

ওয়াজ শুনে বাড়ি ফেরার পথে মহাসড়ক পাড়ি দেয়ার সময় পাবনা থেকে ঢাকাগামী একটি মাইক্রোবাস চাপায় হোসাইন সরদার নামের এক ৯ বছরের শ...