সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
ডাববাগানে পাকবাহিনীর অতর্কিত হামলা//রক্তস্নাত পাইকরহাটি এখন শহীদনগর 004 আবুল বাশার :- নগরবাড়ীর প্রতিরোধ যুদ্ধে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ পরেরদিন কাশিনাথপুর থেকে প্রাং ১০ কিলোমিটার উত্তরে পাইকরহাটির ডাবাগানে এসে সেখানে আবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেয়। পরেরদিন মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল শক্তরাখা এবং ডাববাগানের প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করার জন্য ট্রাকযোগে কিছু খাদ্য সামগ্রী, অস্ত্র, গুলি ও লোকবল নিয়ে মহুকূমা প্রশাসক সামসুদ্দীন ও গণপরিষদ সদস্য আ. রহমান ডাববাগানে পৌঁছেন। সেখানে গিয়ে তারা ট্রাগযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাশিনাথপুরে স্থাপিত পাকবাহিনীর ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালানোর পরিকল্পনা গ্রহন করেন। পরিকল্পনাটি ট্রাক ড্রাইভারের মনোপুত না হওয়ায় সে কৗশলে গোপনে ট্রাকের ইঞ্জিনে যান্ত্রিক ক্রুটি তৈরি করে রাখে। সেদিন বারবার চেষ্টা করেও ট্রাকের ইঞ্জিন চালু করা যায়নি। এ কদিনে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামবাসীর সহায়তায় বগুড়া নগরবাড়ী মহাসড়কের পাইকর হাটি ব্রিজের কাছে বৃহৎ অংশ কেটে সড়ক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। গ্রামের মধ্যে মহাসড়কের পশ্চিমপাড়ে জগৎ বিশ্বাসের বাড়ীর পাশের ডাববাগান ও পুকুর পাড়ে এবং মহা সড়কের পূর্বপাড়ের জনবসতির বাড়িগুলোতে বাংকার তৈরী করে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু বিধি বাম। স্মৃতিচারক ও প্রত্যক্ষ দর্শীদের মতে ১৯ এপ্রিল ১৯৭১, তখন ঠিক দুপুর। মুক্তিযোদ্ধাদের যে গ্রুপ যে অবস্থানে ছিল সেখানে দু’একজনকে সশস্ত্র পাহারা বসিয়ে সবাই খাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউ গোসল সেরে খাবার খেতে বসেছে কেউ পুকুরের পানিতে নেমেছে কেউ নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠিক এমন সময় একাধিক কনভয় ও জিপ গাড়ী নিয়ে ভাড়ী অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। দালালদের সহায়তায় তারা মাঠের মধ্য দিয়ে পায়ে হেটে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ক্যম্পগুলো ঘিড়ে ফেলে। প্রায় ৪ ঘন্টা ব্যাপি এ প্রতিরোধ যুদ্ধ চলে। এ যুদ্ধে আতœœহুতি দেয় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসী। আহত হয় কয়েক’শ নিরাপরাধ মানুষ। যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কেউ বাংকারের মধ্যে কেউবা বাইরে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে এমনকি মাঠের মধ্যেও লাশ পড়ে থাকে। ঐ যুদ্ধে পাকবাহিনীর একটি কনভয় ও একটি জীপ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পাকাবাহিনীর বেশ কিছু হতাহত হয়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনী কিছু সময়ে জন্য পিছু হটে। জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে স্থান ত্যাগ করে দূরবর্তী গ্রামে আশ্রয় নেয়। পাকবাহিনী শক্তি সঞ্চয় করে সন্ধ্যায় বিনা বাঁধায় পুনরায় গ্রামে হামলা চালায়। নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয় ডাববাগান পার্শবর্তী গ্রাম রামভদ্রবাটি, কুড়িয়াল, সাটিয়াকোলা ও বড় গ্রাম। চালায় এক বিভিষিকাময় হত্যাযজ্ঞ। রাতভর পাকবাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে কাশিনাথপুর ক্যাম্পে ফিরে যায়। ওইদিন পাকবাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল সাটিয়াকোলা গ্রামের আব্দুল বাছেদ ও বড় গ্রামের কোকিল মুন্সি। এরা দু’জন পাকবাহিনীর দালালছিল। সকালের দিকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাওয়া গ্রামবাসী একজন দু’জন করে গ্রামে ফিরে আসতে থাকে। তারা এলোপাথারি পরে থাকা মানুষের লাশ ও পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া বাড়িঘর দেখে হতাশ হয়ে পরে। তারা প্রথমেই মৃত লাশগুলোকে যেখানে যে অবস্থায় পরেছিল সেখানে গণকবর দিতে থাকে। নিজেদের তৈরী বাংকারে ঠাই মেলে চেনা অচেনা মুক্তিযোদ্ধাদের। এ মর্মান্তিক ও ভয়াবহ যুদ্ধের কাহিনী ইতিহাসের অন্তরালেই থেকে গেছে । স্মৃতিচারকরা বলেন, রাষ্ট্রচালকেরা এ যুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরাতো দুরে থাক, পরবর্তীতে এলাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ কিম্বা ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা শহীদ ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করতেও আজপর্যন্ত কেই এগিয়ে আসেনি। ডাববাগান এবং বাঘাবাড়ী প্রতিরোধ যুদ্ধে যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাতœক সহযোগিতা করেছিলেন সেই মহুকূমা প্রশাসক সামসুদ্দিন সাহেব পরবর্তীতে তার ভায়রা ভাই চিপ সেক্রেটারী শফিউল আজম (সিএসপি) প্রলোভন ও পরামর্শে পাকবাহিনীর কাছে আতœসমর্পণ করেন। পাকবাহিনী ১৫ মে ১৯৭১ তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে পতিশোধ নেয়। তিনি শহীদদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। ডাববাগানের নেতৃস্থানীয় দুই হাবিলদার মোঃ আকবর আলী (শান্তিডাঙ্গা কুষ্টিয়া) ও আব্দুল আলী (নোয়াখালী) আহত হয়েছিলেন। দুজনই ইপিআর ৭ উইং নওগা,রাজশাহীর সদস্য ছিলেন। আহত হাবিলদার আকবর আলী পরবর্তীতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের যে লাশগুলো সনাক্ত করেছিলেন তারা হলেন, হাবিলদার মোঃ এমদাদ আলী(পাবনা) নায়েক মোঃ মফিজউদ্দিন (ঢাকা) নায়ে মোঃ গোলান আনজাতোন (কুষ্টিয়া) লে. নায়েক মোঃ সালেহ আহমেদ (নোয়াখালী), সিপাহী মোঃ নুরউদ্দিন (বরিশাল), সিপাহি ইলিয়াস (রাজশাহী) সিপাহি আবু হোসেন (রাজশাহী), সিপাহি রফিকুল ইসলাম (রাজশাহী), সিপাহি আবুল কাশেম (রাজশাহী), সিপাহি ইদ্রিস আলী (রাজশাহী), সিপাহি নেফারুল হক (রাজশাহী), সিপাহি আমির হোমেন (রাজশাহী) সিপাহী মোঃ সাইবুর রহমান (রাজশাহী) সিপাহী গোলাম মোস্তফা (সিলেট), সিপাহী আব্দুর রাজ্জাক (যশোর), সিপাহী রমজান আলী (যশোর), বাদবাকি অচেনা লাশ সনাক্ত করা যায়নি। স্থানীয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের যে লাশ সনাক্ত করা হয়েছিল তারা হলেন, ডাঃ আফাজ উদ্দিন (সমাশনারী,সাথিয়া),ইমান (মহিষখোলা সাথিয়া), জগত নরায়ন বিশ্বাস (পাইকরহাটী,সাথিয়া), আ. লতিফ (সাথিয়া), পিয়ার মন্ডল (সাথিয়া), কাজেম প্রাঃ (সাথিয়া), মহর পাগল (পাইকরহাটি সাথিয়া), জাকের আলী শেখ (সাথিয়া), সোন্তোষ ( সাথিয়া),শাহজাহান বিএসসি (সৈয়দপুর,সুজানগর),সৈয়দ আলী (আতোপসোভা,সাথিয়া), বাদবাকিদের সনাক্ত করা যায়নি। সনান্ত রকরা না গেলেও তারো অজো চির নিদ্রায় শায়িত রয়েছেন এই ডাববাগান শহীদ নগরে। পাইকরহাটির (শহীদ নগরের) এই রক্তস্নাত মাটিতে। এটি সত্য যে, শহীদ ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রচিত হয়নি কোনো ইতিহাস। তাদের ভাগ্যে আজো মেলেনি কোনো বীরবিক্রম, বীর প্রতিক কিম্বা বীর শ্রেষ্ঠ নামক রাষ্ট্রীয় উপাধী। ডাববাগানের যুদ্ধ ইতিহাসের অন্তরালেই চাপা পড়ে রয়েছে। ঐ যুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ৭০ জন সৈন্য নিহত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এ যুদ্ধের ঘটনা প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে বীর শহীদদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ ওই গ্রামের অংশবিশেষ শহীদনগর নামকরণ করা হয়। ডাববাগান যুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক হত্যাযজ্ঞ এবং ধ্বংসযজ্ঞ এ এলাকার মানুষের মনকে এখনও শিহরিত করে। এ কারনে আগামী দিনের প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় করে রাখার জন্য শহীদনগরে একটি স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। ওই স্মৃতি ভাস্কর্য ১৯ এপ্রিল, ২০০১ সালে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ উদ্বোধন করেন। বিভিন্ন সময়ে এ যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারী যারা ভয়াবহ ঐ যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেছিলেন স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘ ৪৩ বছর পর এদের অনেকেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন। এই ঐতিহাসিক যুদ্ধের যারা স্মৃতি চারণ করেছিলেন বা করেছেন তারা হলেন, শাহজাদপুর থেকে নির্বাচিত প্রয়াত সাবেক গণপরিষদ সদস্য আব্দুর রহমান, (৭৫) প্রয়াত আবুল চৌধুরী (৭৮)), পাইকরহাটী ডাববাগান গ্রামের মোঃ হোসেন আলী (৭১), আয়েনউদ্দিন ফকির (৭৩) মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন (৬২)কাজী আজম (৬১) বড়গ্রামের আজিজল প্রা (৭৬) আতপসোভা গ্রামের আ, ছামাদ মুন্সি (৮৫) প্রমুখ।

সম্পর্কিত সংবাদ

সিরাজগঞ্জে ২'শ ৮৫ পিছ ইয়াবা ও ২ কেজি ৯'শ৫০ গ্রাম গাঁজাসহ আটক ২

সিরাজগঞ্জ জেলার সংবাদ

সিরাজগঞ্জে ২'শ ৮৫ পিছ ইয়াবা ও ২ কেজি ৯'শ৫০ গ্রাম গাঁজাসহ আটক ২

র‍্যাব-১২ এর মাদকবিরোধী অভিযানকে সাধুবাদ জানিয়েছে জেলাবাসী।

জোর করে উপবৃত্তির টাকা কেটে নেবার জেরে প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির উপর হামলা মারপিট, আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার

শিক্ষাঙ্গন

জোর করে উপবৃত্তির টাকা কেটে নেবার জেরে প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির উপর হামলা মারপিট, আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার

উল্লাপাড়া প্রতিনিধিঃ শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে জোর করে উপবৃত্তির টাকা কেটে নেওয়া ও এর প্রত...

নতুন নিয়মে ৩৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারি

শিক্ষাঙ্গন

নতুন নিয়মে ৩৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারি