সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
শামছুর রহমান শিশির : সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার যমুনা নদী তীরবর্তী দুর্গম পল্লী অঞ্চলের শরিফুল, মাসুদ ও মিলনের শরীরে হাঁতুড়ি দিয়ে ইট ভেঙ্গে খোঁয়া তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি না থাকলেও পেটের তাগিদে ওরা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। পিতা হারিয়ে এই ছোট্ট বয়সেই এসব ভাগ্যবিড়ম্বিত চির অবহেলিত, চির পতিত, চির অপাংক্তেয়, যাদের বিচারের রায় নিরবে নিভৃতে কাঁদে-এসব শিশুদের বইখাতা আর কলমের পরিবর্তে হাতে তুলে নিয়েছে হাঁতুড়ি। হৎদরিদ্র পরিবারের এসব কোমলমতি শিশুরা শুধুই পেটের তাগিদে রোদ্রদাহে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ইট ভাঙ্গার কাজ করছে। এমন করুণ চিত্র বড়ই করুণ,পীড়াদায়ক ও অবিশ্বাস্য হলেও কাজ করলে এমনই এসব শিশুদের পেটে ভাত যায়,আর কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হয়।গরিবের ঘরে জন্ম ! এ জন্যই মাত্র ৫/৬ বছর বয়স থেকেই ওদেরকে জীবনযুদ্ধের মতো অমোঘ, নির্মম, নিষ্ঠুর, মর্মাহত, কঠিন বাস্তবতার সন্মুখীন হতে হয়েছে। ওদের পাশে দাড়ানোর কি কেউ নেই! সরেজমিন শাহজাদপুর উপজেলার যমুনা নদী তীরবর্তী এলাকা পরিদর্শন করে জানা গেছে, যমুনা নদী তীরবর্তী বিভিন্ন সিমেন্টের খুঁটি ও সেনেটারী ল্যাট্রিন প্রস্তুতকারী কারখানায় ওইসব কোমলমতি শিশুরা কাজ করছে। এক কড়াই খোয়া ভাঙ্গলে তারা মাত্র ৪ টাকা মজুরী পায়। শুধু এ তিন শিশুই নয়, একই এলাকার জাহাঙ্গীর, শাহীন, চয়ন, মোন্নাফসহ প্রায় ১০/১২ টি সমবয়সী শিশুরা এসব কারখানায় নিয়মিত ইট ভেঙ্গে জীবিকা নির্বাহ করছে। হাঁতুড়ি উচু করতেই এসব শিশুদের চরম কষ্ট হলেও পরিবারে অর্থ উপার্জনকারী না থাকায় ৪/৫ জনের এসব শিশুদের সংসার তাদের আয়ের ওপরই চলছে। দেশে শিশুদের দিয়ে কাজ করানোর ব্যপারে বিধিনিষেধ থাকলেও ওই কারখানার মালিক মানবতার প্রশ্নে এসব শিশুদের কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। দিনভর হাড়ভাঙ্গা মেহনত, খাঁটুনি করে কঙ্কালসার এসব শিশুরা সন্ধ্যায় ৩০/৪০ টাকা আয় করে সেই অর্থ দিয়ে চাউল ও তরকারি কিনে বাড়িতে যায়। শিশু শরিফুল, মাসুদ ও মিলনকে লেখাপড়ার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে এরা জানায়, লেহাপড়া করলি কি প্যাটে ভাত যাইবে। কাম করলি প্যাটে বাত জায় আর কাম না করলি মাও খাইব্যার দেয়না। শিশু সুজনের বাবা স্বর্গীয় মদন ঋষি মারা গেছেন অনেকদিন হলো। শাহজাদপুর পৌরসদরের ঋষিপাড়ায় তার বসবাস। মায়ের পক্ষে পরিবারের ভরণপোষনের কাজ বেশ দূরহ হয়ে পড়েছে।তাই ও যখন একটু বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই মায়ের তাগাদা কাজ করার।কারন দু’চার টাকা যাই আসুক তাই সংসারের কাজে লাগবে। লেখাপড়া করে কি হবে ? লেখাপড়া করলে তো আর পেট চলবে না ! তাই মায়ের নির্দেশ মোতাবেক যৎসামান্য মজুরীর বিনিময়ে তাকে পৌরসদরের মণিরামপুর বাজারের একটি হোটেলে কাজ করতে হচ্ছে।একই হোটেলে যৎসামান্য মজুরীর বিনিময়ে শিশুশ্রম দেয় একই এলাকার ঋষিপাড়া গ্রামের সোনাদাসের শিশুপুত্র স্বপন । সেও বাবা মায়ের নির্দেশে লেখাপড়ার জন্য বিদ্যালয়ে না গিয়ে অতি স্বল্প শিশুশ্রমের বিনিময়ে হোটেলে শ্রম দিচ্ছে। উপজেলার পৌরসদরের বিভিন্ন স্থানে হেডমিস্ত্রির অধীনে কাজ করে এমন আরও কয়েকটি ঝড়ে পড়া শিশু হচ্ছে চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বাবুপুর গ্রামের বাদশা মিয়ার ছেলে ইদুল। পিতা বাদশা স্ত্রী ও ৫ সন্তানের ভরনপোষনে রীতিমতো চোখেমুখে সর্ষের ফুল দেখায় অতি অল্প বয়সেই আদরের সন্তান ইদুলকে বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে শাহজাদপুরে রাজমিত্রির হেলপার হিসাবে কাজে পাঠিয়েছে। একই গ্রাম বাবুপুর গ্রামের এক লছিমন চালকের শিশু সন্তান রিপনকেও ইদুলের মতোই পেটের দায়ে এখানে কাজ করতে হচ্ছে। শিবগঞ্জের বহলবাড়ী গ্রামের নাছির মিয়ার ফুটফুটে ছেলে নাছিমকেও বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে মায়া মমতা জলাঞ্জলি দিয়ে অতি অল্প বয়সেই তাদের আদরের ধনকে চোখের অনেক দুরে কাজের জন্য পাঠানো হয়েছে। নাছিম ৩ বছর ধরে শাহজাদপুরে রাজমিত্রির কাজে হেলপার হিসাবে শিশুশ্রম দিচ্ছে। তিন ভাইবোনসহ ৫ সদস্যবিশিষ্ট নাছিমদের সংসারে অভাব অনটনের কারনেই খুব ছোট্ট বয়স থেকেই লেখাপড়া বাদ দিয়ে তাকে কাজ শেখানোর জন্য বহুদুরে শাহজাদপুরে পাঠানো হচ্ছে। একই এলাকার খালেককেও কাজ করতে হচ্ছে ইদুল,রিপন, নাছিমের মতো রাজমিস্ত্রির হেলপার হিসাবে। এরা সবাই হেডমিত্রি শিবগঞ্জ উপজেলার ছোটচক ঘোড়পাকিয়া গ্রামের ফাকু মন্ডলের ছেলে টসিকুলের অধীনে কাজ করছে। শুধু ওইসব শিশুরা নয়,তাদের মতো শাহজাদপুরসহ পাবনা-সিরাজগঞ্জের শতশত কোমলমতি শিশুদের কাউকে রিক্সা চালাতে, কাউকে কাপড়ের গাইট(বান্ডিল) মাথায় নিয়ে আড়ৎ আড়তে পৌছানোর কাজে, সুতার বান্ডিল মাথায় নিয়ে বিভিন্ন স্থানে পৌছে দিতে, বিভিন্ন হোটেলসহ অনেক পেশায়ই কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। হাটের দিন শাহজাদপুর কাপড়ের হাটে এরূপ অসংখ্য ঝড়ে পড়া শিশু কিশোরদের আনাগোনা ঘটে। ‘গাইটটা দ্যান না ভাই,যা দেন (টাকা) দিয়েন তাও গাইটটা দেন’-এমন চিৎকার, করুণ অনুনয় বিনয় করতে দেখা যায় অসংখ্য ঝড়ে পড়া শিশু কিশোরদেরকে শুধুই তাদের পেটের তাগিদে-বাবা মায়ের ভয়ে! অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পিতামাতার অবহেলা, চরম অজ্ঞতা আর ভরণপোষনে অক্ষমতাজনিত কারনে শাহজাদপুরসহ পাবনা-সিরাজগঞ্জের শরিফুল, মাসুদ, মিলন, ইদুল, রিপন, নাছিম ও খালেকের মতো ঝড়ে পড়া শত শত শিশুরা পেটের তাগিদে বিদ্যালয়ে না গিয়ে শিশুশ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছে। নুন আনতে পান্তা ফুরানো অতি হৎদরিদ্র পরিবারে অভিশাপরূপে জন্ম নেওয়া (পিতামাতার ভাষায়) ওইসব ফুটফুটে শিশু কিশোরদেরকে পেটের তাগিদে অল্প বয়স থেকেই জীবন সংগ্রামে পতিত হতে হয়েছে। তাদের অনেকেরই হয়তো বাবা-মাও হয়তো জন্মের পর বিদ্যালয়ে যেতে পারেনি তাদের দাদা-দাদীদের চরম দারিদ্রতা জনিত কারনে। আর সে জন্যই শুধূমাত্র সচেতনতার অভাবে বোধহয় তাদের কোমলমতি শিশু কিশোরদের বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে কাজে পাঠাচ্ছে অভাবগ্রস্থ পিতামাতারা। ফলে ‘শরীরে ওদের না কুলালেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে ! বর্তমানে দেশে প্রচলিত বিনা খরচে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও ওদের মতো চির অবহেলিত, চির পতিত, চির অপাংক্তেয় হৎদরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য নাকি লেখাপড়া নয়। আর লেখাপড়া করেই বা কি হবে ? জজ ব্যারিষ্টার তো আর হতে পারবেনা, কদিন পরে বাবার মতোই ঘানি টানতে হবে। তাই তাদের পিতামাতার ভাষ্যমতে,সময় নষ্ট না করে পরিবারের স্বার্থেই তাদের ছোটবেলা থেকে কাজে পাঠানো হচ্ছে।ফলে ওইসব ঝড়ে পড়া শিশু কিশোরদের বিচারের রায় নিরবে নিভৃতে কাঁদছে! ওইসব ফুটটুটে শিশু কিশোরদের লেখাপড়া কেন করানো হচ্ছেনা ? এমন প্রশ্নে পিতামাতার বক্তব্য,‘ট্যাহা ছ্যাড়া বই পত্তর পড়া যায়,কিন্তু মোগো ছেলেপেলে লিয়্যা মোরা না খাইয়্যা থাকলি কি আপনেরা ভাত কাপুর দিব্যাননি’-এমন প্রশ্নরও কোন সদুত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি।ফলে ওদের মতো শত শত কঁচিকাঁচা কোমলমতি শিশু কিশোররা দারিদ্রতা ও বাবা মায়ের চরম অবহেলায় খুব ছোটবেলা থেকেই জীবন সংগ্রামে পতিত হয়ে ঝড়ে পড়লেও দেখার কেউ নেই।

সম্পর্কিত সংবাদ

বিগ ডাটা কি এবং কেন! ( What is Big Data and Why? )

ফটোগ্যালারী

বিগ ডাটা কি এবং কেন! ( What is Big Data and Why? )

একটা সময় ছিলো যখন আমরা আমাদের সবকিছুই কাগজে লিখে রাখতাম। কখন খেতে যাবো, কবে মিটিং, কখন শপিং এ যাবো এসব টু ডু লিস্টগ...

শাহজাদপুরে কলেজ ছাত্র সাব্বির হত্যা মামলার বিচার কাজ ৬ বছরেও শেষ হয়নি

অপরাধ

শাহজাদপুরে কলেজ ছাত্র সাব্বির হত্যা মামলার বিচার কাজ ৬ বছরেও শেষ হয়নি

শাহজাদপুর সংবাদ ডটকম, শামছুর রহমান শিশির, বুধবার, ২২ আগস্ট ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ : শাহজাদপুর সরকারি কলেজের মেধাবী ছাত্র সাব্ব...

যেভাবে ইসতিসকার নামাজ আদায় করেছিলেন নবিজি (সা.)

ধর্ম

যেভাবে ইসতিসকার নামাজ আদায় করেছিলেন নবিজি (সা.)

ইসতিসকা শব্দের অর্থ পানি বা বৃষ্টি প্রার্থনা করা। সালাতুল ইসতিসকা অর্থ বৃষ্টি প্রার্থনার নামাজ। শারিয়তের পরিভাষায় অনাবৃষ...

শাহজাদপুরে ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং শুভ উদ্বোধন

অর্থ-বাণিজ্য

শাহজাদপুরে ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং শুভ উদ্বোধন

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর এজেন্ট ব্যাংকিং কেন্দ্র সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার জামিরতা বাজারে শুভ উদ্বোধন করা হ...

আনন্দঘন পরিবেশে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান শুরু

শিক্ষাঙ্গন

আনন্দঘন পরিবেশে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান শুরু

ফারুক হাসান কাহার, শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি: আনন্দঘন ও উৎসবমূখর পরিবেশে পাঠদানের মধ্যদিয়ে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর...

ঢাকার কাফরুলে মুক্তিযোদ্ধাদের মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

মুক্তিযুদ্ধ

ঢাকার কাফরুলে মুক্তিযোদ্ধাদের মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ গতকাল শনিবার বিকেলে ঢাকার কাফরুল থানা এলাকার পার্ক (চাইনিজ) হোটেলে মহানগর মুক্তিযোদ্ধাদের এক মত বিনিময়...