বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
সিরাজগঞ্জ: স্থানীয়ভাবে তাঁতবস্ত্রের চাহিদা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় সিরাজগঞ্জের লাখ লাখ তাঁত মালিকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি না হওয়ায় লোকসানের পড়ে তাঁত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। পুঁজি হারিয়ে অনেকেই পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন। এর প্রভাব সকল ব্যবসার উপর পড়ছে। গত দুই বছর ধরে এই অবস্থা শুরু হয়েছে। তাঁত মালিকরা বলেছেন, এভাবে লোকসান অব্যাহত থাকলে এই শিল্প অচিরেই বিলীন হয়ে যাবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদেশে রফতানি এবং দেশে চাহিদা কমে যাওয়ায় বাজার প্রতিদিন নিম্ন মুখি হচ্ছে। সরকারিভাবে পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যত অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারন করবে। অনেকেরই মত প্রকাশ কররেছেন, সকল শ্রেণীপেশার নারীরা সালোয়ার কামিজ বেশী ব্যবহার করায় শাড়ীর ব্যবহার কমে যায়। আর এতেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাঁত মালিক ও ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৩ সাল থেকে তাঁতের ব্যবসায় মন্দা ভাব শুরু হয়। ২০১৪ সাল থেকে মন্দাভাব স্থায়ী রূপনেয়। একই সঙ্গে তাঁতের উৎপাদিত পণ্য (শাড়ী লুঙ্গী) বিক্রি অর্ধেকে নেমে আসে। উৎপাদিত পণ্য লোকসানে বিক্রি করায় তাঁতিরা পুজি হারাতে থাকে। বিশেষ করে প্রান্তিক তাঁতিরা (১ থেকে ১০ পর্যন্ত) চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় অনেকেই তাঁত বিক্রি করে দিয়ে কেউ পোষাক শিল্পে, কেউ রিক্সা চালকের কাজ নিয়েছেন। অনেকেই পুঁজি হারিয়ে এলাকা থেকে পালিয়ে যান। বর্তমানে প্রায় অর্ধেক তাঁত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঋণগ্রহিতরা তাদের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। তাঁত বিক্রি করতে না পারায় অনেকেই খড়ি হিসেবে তাঁতের কাঠ ও ভাঙ্গুরীর দোকানে লোহা বিক্রয় করছে। তাঁতবোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ জেলাটি তাঁত সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিত। নয়টি উপজেলার মধ্যে শাহজাদপুর, বেলকুচি, সদর, উল্লাপাড়া ও চৌহালী উপজেলায় তাঁতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। ২০০৩ সালের তাঁতবোর্ডের জরিপ অনুযায়ী হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা এক লাখ ৬০ হাজার এবং বিদ্যুত চালিত পাওয়ারলুমের সংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার। এই তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ পরিবারের ত্রিশ লাখ শিশু ও নারী পুরুষ। এ ছাড়াও অনান্য ব্যবসা ও পেশার লোকজনও এর উপর নির্ভরশীল। এদের ভরণ পোষন এই শিল্পর উপর নির্ভর শীল। তাঁত শিল্পর উপর নির্ভর করে শাহজাদপুর, বেলকুচি ও চৌহালীর এনায়েতপুরে তিনটি কাপড়ের হাট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে শাহজাদপুরের কাপড়ের হাটটি দেশের মধ্যে বৃহত্তম। বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যবসায়ীরা আরও জানান, শাহজাদপুরের হাটে প্রতি সপ্তাহে চারদিন (দিনরাত মিলে) কাপড় বিক্রি হয়ে থাকে। দেশের সকল জেলা থেকে ব্যবসায়ী ও দোকান মালিকরা শাড়ী, লুঙ্গি ক্রয় করে থাকে। এই হাট থেকে প্রতিহাটে ভারতে শাড়ী ও লুঙ্গি রফতানি হয়ে থাকে। প্রতি হাটে ব্যাংক ও নগদসহ প্রায় শতাধিক কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। বর্তমানে ক্রয়-বিক্রয়, রফতানী ও ব্যাংকের লেনদেন অর্ধেকে নেমে এসেছে। সেই সঙ্গে খেলাপী ঋণের সংখ্যাও বাড়ছে। শাহজাদপুরের কৈজুরী ইউনিয়নের জগতলা গ্রামের তাঁতবোর্ডের আওতায় ৩নং ওয়ার্ড তাঁতী সমিতির সভাপতি মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নিজের ১৫টি তাঁত ছিলো। তাঁতবোর্ড থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। প্রতিটি শাড়ী কাপড় উৎপাদনে খরচ হয় ৬শ’ টাকা। বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫শ’ টাকা। তাও বাকিতে। যে কারণে বাধ্য হয়ে বন্ধ করে বর্তমানে পাঁচটি তাঁত চালু রেখেছি। এখন ঋণের কিস্তির টাকা দিতে পারছিনা। তিনি আরও বলেন, আমার গ্রামের মাসুদ রাণা, তফিজ উদ্দিন, গফুর মিয়া, ইমান আলী, আলম মিয়া তাঁত বিক্রি করে দিয়ে এখন ঢাকায় পোষাক শিল্পে শ্রমিকের কাজ করছেন, কেউ রিক্সা চালাচ্ছেন। নাম প্রকাশ করার না শর্তে রূপপুর মহল্লার কয়েকজন তাঁত মালিক বলেন, পুঁজি হারিয়ে তাঁত বিক্রি করে দিয়ে রাতের আধারে গ্রাম থেকে চলে এসেছি। এলাকায় এক সময় প্রচুর দাপট ছিলো। অনেক দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করেছি। নিস্ব হয়ে মানসন্মানের কারণে বাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়েছি। খুকনী গ্রামের মিল্টন কটেজ ইন্ড্রাষ্ট্রিজ এর স্বত্বাধিকারী আলহাজ্ব মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ ৪০ বছর ব্যবসা জীবনে এমন ভয়াবহ অবস্থা কোনদিন দেখিনি। কাপড় বিক্রি করে শ্রমিকের মজুরীর টাকাই জোগাড় হচ্ছেনা। গুদামে কয়েক কোটি টাকার কাপড় মজুদ হয়ে আছে। জমি বিক্রি করে বাংকের সুদের ১৬লাখ টাকা দিয়েছি। মোট ৩০৪টি তাঁতের মধ্যে ঐতিহ্য ধরে রাখতে মাত্র ৯৫টি তাঁত চালু রেখেছি। রফতানিকারক মেসার্স রায় ট্রেডার্স এর স্বত্বাধিকার নিত্য নন্দ রায় বলেন, শুল্কমুক্ত হওয়ায় তিনবছর আগে ৬টি রফতানীকারক প্রতিষ্ঠান শাহজাদপুরের প্রতি হাট থেকে চার লাখ পিচ শাড়ী ও লুঙ্গী ভারতে রফতানী করা হতো। এ ছাড়াও যেসকল দেশে বাঙালীরা বসবাস করেন সে দেশেও কাপড় রফতানী হতো। দুই বছর ধরে ভারতের রাজ্য সরকার ৬শতাংশ শুল্ক আরোপ, ভারতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশে ডলারের মূল্য কমে যাওয়ায় রফতানীর পরিমান অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। বর্তমানে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা না করা হলে এই পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারন করবে। আমরা রফতানী কারক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশসহ ভারত সরকারের প্রতিনিধির কাছে এ বিষয়ে একাধিকবার জানিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়নি। শাহজাদপুরের সংবাদপত্র ব্যবসায়ী সন্তোষ কুমার সাহা বলেন, বর্তমানে সকল শ্রেণীর নারীরা শাড়ীর পরিবর্তে সালোয়ার, কামিজ ব্যবহার করছেন। যে কারণে শাড়ীর ব্যবহার কমছে। তাঁত ব্যাবসা মন্দা থাকার কারণে সকল ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা ভাবনা করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। বাণিজ্যিক প্রাইভেট ব্যাংকের ব্যবস্থাপকদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন, মোনায়েম আহমেদ, রফিকুল ইসলাম জানান, গত তিনবছরের অনুপাতে বর্তমানে লেনদেন অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। বেশিরভাগ তাঁতমালিকরা শুধু শাড়ী ও লুঙ্গি তৈরি করে থাকেন। অন্য কোন কাপড় তারা তৈরি করেন না। যে কারণে বাজার মন্দ হওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে। উৎপাদিত কাপড় কমমূল্যে, বাকিতে এবং চেকের মাধ্যমে বিক্রি করায় ব্যাংকে টাকা দিতে পারছেন না। যে কারণে খেলাপী ঋনের সংখ্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশ তাঁতবস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হাসান বলেন, তাঁত শিল্পের প্রতি সরকারের কোন সুনজর নেই। সারাদেশের প্রায় তিনকোটি লোক এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল। অব্যাহত লোকসানের কারণে অর্ধেক তাঁত বন্ধ হয়ে তাঁতমালিক ও শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। প্রান্তিক তাঁতীরা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে সবাইকে পথে বসতে হবে। শাহজাদপুর তাঁতবোর্ডের লিয়াজো কর্মকর্তা ওয়াজেদ আলী বলেন, বাজার ব্যবসার পরিবর্তন ও তাঁতের উপকরণের সহজলভ্য করতে হবে। তা না হলে তাঁত শিল্প নতুন জীবন ফিরে পাবে না।       রিপোর্ট: বিশেষ প্রতিবেদক, দৈনিক আজকের সিরাজগঞ্জ

সম্পর্কিত সংবাদ

মিল্ক ভিটার অনিয়মের বিরুদ্ধে শাহজাদপুরে সমবায়ীদের প্রতিবাদ

শাহজাদপুর

মিল্ক ভিটার অনিয়মের বিরুদ্ধে শাহজাদপুরে সমবায়ীদের প্রতিবাদ

‘সমবায়ী বাঁচলে মিল্ক ভিটা বাঁচবে’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটার বিভিন্ন অনিয়মের...

অপ্রয়োজনে গাছ কাটার শাস্তি ভয়াবহ

ধর্ম

অপ্রয়োজনে গাছ কাটার শাস্তি ভয়াবহ

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন দেয় এই গাছ। শুধু তাই নয়, মানুষ প্রশ্বাসের সঙ্গে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে গাছ তা...

যেভাবে ইসতিসকার নামাজ আদায় করেছিলেন নবিজি (সা.)

ধর্ম

যেভাবে ইসতিসকার নামাজ আদায় করেছিলেন নবিজি (সা.)

ইসতিসকা শব্দের অর্থ পানি বা বৃষ্টি প্রার্থনা করা। সালাতুল ইসতিসকা অর্থ বৃষ্টি প্রার্থনার নামাজ। শারিয়তের পরিভাষায় অনাবৃষ...

শাহজাদপুরে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত

শাহজাদপুর

শাহজাদপুরে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত

সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলের বর্বর হামলার প্রতিবাদে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের সামাজিক ও মানবিক সংগঠন...

মিষ্টান্ননগরী  সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর

শাহজাদপুর

মিষ্টান্ননগরী সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর

শাহজাদপুরে ছোট-বড় অনেক জমিদার ছিল। বিভিন্ন উৎসব-পূজা-পার্বণে তারা প্রজাদের নিমন্ত্রণ করে পেটপুরে মিষ্টি খাওয়াতেন। তারা ব...

উল্লাপাড়ায় হিরোইনসহ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার

অপরাধ

উল্লাপাড়ায় হিরোইনসহ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার

উল্লাপাড়া প্রতিনিধিঃ উল্লাপাড়ায় হিরোইনসহ নাজমুল হাসান (২০) নামে এক মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শনিবার (০৮ জুলাই...