

সিরাজগঞ্জ জেলার দুগ্ধশিল্প ও তাঁতসমৃদ্ধ শাহজাদপুর উপজেলার প্রাণকেন্দ্র দ্বারিয়াপুরে অবস্থিত উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহৎ শাহজাদপুর কাপড়ের হাট সংলগ্ন এলাকায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারিবাড়িতে প্রতিদিনই দেশ বিদেশ থেকে আগত পর্যটক ও বরীন্দ্র ভক্ত অনুরাগীদের আগমন ঘটছে। তাদের পদচারনায় ও মিলনমেলায় মুখরিত ও প্রাঞ্জলিত হয়ে ওঠে বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত কাছাড়িবাড়ি প্রাঙ্গণসহ আশপাশের অঞ্চল। বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুরের কাছাড়িবাড়িতে এসে ভক্তরা কবিগুরুর ব্যবহৃত বসতবাড়ি, আসবাবপত্র ও বিভিন্ন সরঞ্জামাদি দেখে তৃপ্তি ঢেঁকুর ফেলে ঘরে ফিরছেন।
জানা গেছে, প্রতি বছরেরই ২৫, ২৬ ও ২৭ বৈশাখে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকীতে রেকর্ড পরিমান রবীন্দ্রভক্ত দেশী-বিদেশী নারী, পুরুষ, শিশু কিশোর, যুবক-যুবতীর সমাগম ঘটে। কবিগুরুর জন্মজয়ন্তী উৎসবে কাছারিবাড়িতে তিল ধারনের যায়গা নেই এমন অবস্থা দেখা যায়।
সংশিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছরের নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাহজাদপুরের কাছাড়িবাড়িতে অসংখ্য দেশী বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রতি বছরের বৈশাখ মাসে এখানে বৈশাখী সাজে জনমানুষের ঢল পরিলক্ষিত হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, শাহজাদপুরের কাছারিবাড়ি রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত একটি ঐতিহাসিক স্থান ও পর্যটন কেন্দ্র। তিন তৌজির অন্তর্গত ডিহি শাহজাদপুরের জমিদারী একদা নাটোরের রানী ভবানীর জমিদারীর অংশ ছিল। ১৮৪০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারী নিলামে উঠলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মাত্র তের টাকা দশ আনায় এই জমিদারী কিনে নেন। জমিদারীর সাথে সাথে ওই কাছারিবাড়িও ঠাকুর পরিবারের হস্তগত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। আগে কাছারিবাড়ির মালিক ছিল নীলকর সাহেবরা। ১৮৯০ সাল থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত কবিগুরু রবীন্দ্রনাঠ ঠাকুর জমিদারী দেখাশোনার কাজে শাহজাদপুরে সাময়িকভাবে আসা যাওয়া ও বসবাস করতেন। তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। সম্ভবত এই কারণেই শিলাইদহে তাঁর বাসগৃহ কুঠিবাড়ি নামে এবং শাহজাদপুরের বাড়িটি কাছারিবাড়ি নামে পরিচিত। আগে কাছারিবাড়িতে নীলকর সাহেবরা বসবাস করতেন।
ভক্তরা জানায়, শাহজাদপুরে কবিগুরু ঘুরে বেড়িয়েছেন পালকিতে, নৌকায় ও পায়ে হেটে। শাহজাদপুর পৌর এলাকার প্রাণকেন্দ্র দ্বারিয়াপুর বাজারে অবস্থিত উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহত শাহজাদপুর কাপড়ের হাটের দক্ষিণ পাশে এক সবুজ শ্যামল পরিবেশে কাছারিবাড়ি অবস্থিত। শাহজাদপুরের কাছারিবাড়িটি ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত একটি দ্বিতল ভবন। ভবনটির দৈর্ঘ্য ২৬.৮৫ মিটার, প্রস্থ ১০.২০ মিটার এবং উচ্চতা ৮.৭৪ মিটার। ভবনটির দ্বো-তলার সিড়ি ব্যাতিত মোট সাতটি কক্ষ রয়েছে। ভবনটির উত্তর দক্ষিণে একই মাপের প্রশস্ত বারান্দা, বারান্দার গোলাকৃতির জোরামাপের খাম ও উপরাংশে আছে অলংকরণ করা বড় মাপের দরজা, জানালা ও ছাদের ওপরে প্যারাপেট দেয়ালে পোড়ামাটির শিল্পকর্ম পর্যটক ও ভক্তদের বিশেষভাবে দৃষ্টি কেড়ে থাকে। ভবনটির জানালা দিয়ে চারপাশের মনোরম, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ কবিগুরু উপলব্ধি করতেন। কাছারিবাড়িতে বসেই রবি কবি প্রাণভরে ছোট নদী দেখতেন ও শুনতেন ছোটনদীর স্রোতধারার মিশ্রিত সুর।
শাহজাদপুরে এসে মানুষ ও প্রকৃতিকে গভীরভাবে ভালবেসেছিলেন কবিগুরু। এখানে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন সাহিত্য সৃষ্টির নানা উপাদান। এখানে অবস্থানকালে তিনি রচনা করেন, সোনারতরী , বৈষ্ণব কবিতা, দুটি পাখি, আকাশের চাঁদ, পুরস্কার, যমুনা, হৃদয়, ভরা ভাদরে, প্রত্যাক্ষান ও লজ্জা, চিত্রা, শীত ও বসন্তে, নগর সংগীত, নদীযাত্রা, মৃত্যু মাধুরী, স্মৃতি বিলয়, প্রথম চুম্বন, শেষ চুম্বন, যাত্রী, তৃণ, ঐশ্বর্য, স্বার্থ, প্রেয়সী, শান্তিময়, কালিদাসের প্রতি, কুমার, মানষলোক, কাব্য প্রার্থনা, ইছামতী নদী, সুশ্রুসা, অশিক্ষাগ্রহন, বিদায়, নববিবাহ, রজ্জিতা, বিদায়, হত্যভাগ্যেও গান, গতোনিক, বঞ্চনা, সংকোচ, মানষপ্রতিভা, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, ব্যবধান, তারাপ্রসন্নের কীর্তি, ছুটি, সম্পত্তি, ক্ষুধিত পাষাণ, অতিথি ইত্যাদি। এছাড়া কবিগুরু এখানে অবস্থান করে ৩৮ টি বিভিন্ন ছিন্ন পত্রাবলী। পঞ্চভূতের অংশবিশেষ ও নাটক বিসর্জন রচনা করেছিলেন।
শাহজাদপুরে কবিগুরুর কাছারিবাড়ির দ্বো-তলার আশপাশে শোভা বর্ধনের জন্য নানা ফুলের গাছে ঘেরা কবিগুরুর অপরূপ কাছারিবাড়িটি বহুদুরের পথিকেরও দৃষ্টি আকর্ষন করে। কাছারিবাড়ির চারদিক প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রাচীরের আশেপাশে রয়েছে নানা দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষের বাগান। কাছারিবাড়ির ভিতরে একটি বকুলগাছ ছিল। কবি ওই গাছের নীচে বসে কবিতা লিখতেন।
১৯৬৯ সালে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক অত্যন্ত জরাজীর্ণ অবস্থায় কাছাড়িবাড়িকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এরপর কাছাড়িবাড়ির মূল ভবনটির নানা সংস্কার কাজ সমাপ্ত করে ভবনটিতে রবীন্দ্রভিত্তিক আলোকচিত্র ও কবিগুরুর ব্যবহৃত নানা আসবাপত্র তৈজসপত্র সরঞ্জামাদি নিয়ে একটি রবীন্দ্রস্মৃতি যাদুঘরের রুপ দেয়া হয়েছে। দক্ষিণ দিকের দরজা দিয়ে ওই যাদুঘরে প্রবেশ করতে হয়। নিচতলা ও দ্বো-তলার বিশাল হলরুমসহ যাদুঘরের সকল কক্ষ দেশি বিদেশি পর্যটকসহ সর্বসাধারনের দর্শণের জন্য উন্মুক্ত থাকে। চারদিকে পাঁকা দেয়ালে বেষ্ঠিত কাছারিবাড়ির আঙ্গিনাটিও বেশ বড়। এখানে রয়েছে রবীন্দ্র মিলনায়তন, কবিগুরুর ব্যবহৃত সামগ্রীর মধে চৌকি, লেখার জন্য ডেস্ক, সোফাসেট, আরাম কেদারা, আলনা, আলমারী, সিন্দুক, ঘাস কাটার যন্ত্র, ওয়াটার ফিল্টার, ল্যাম্প, কবির স্বহস্তে আঁকা ছবি, দেশী বিদেশী রাষ্ট্রনায়ক, বিজ্ঞানীসহ গুণীজনদের সাথে তোলা কবিগুরুর অগনিত ছবি। তাই এই বৈশাখে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছাড়িবাড়িতে অসংখ্য রবীন্দ অনুরাগী ও ভক্তদের আগমন ঘটছে।
সম্পর্কিত সংবাদ

ফটোগ্যালারী
শাহজাদপুরে বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যহতঃ যমুনার ভাঙ্গণে ২ শতাধিক ঘরবাড়ি বিলিন
মোঃ মুমীদুজ্জামান জাহানঃ শাহজাদপুরে বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যহত থাকায় উপজেলার সোনাতুনি ইউনিয়নে যমুনা নদীর ভাঙ্গণ ভয়াবহ আকা...

জীবনজাপন
‘আর কতজ্বাল বুনমু তাঁতে, দুখ পাথারে ভাইস্যা !’ শাহজাদপুরের তাঁত শ্রমিকদের মানবেতর দিনযাপন
শামছুর রহমান শিশির, শাহজাদপুর থেকে : বরেণ্য কন্ঠশিল্পী আব্দুল আলিমের লেখা ও তার কন্ঠে গাওয়া জননন্দিত ‘আর কতোকাল ভাসবো আম...

স্বাস্থ্য
শাহজাদপুরে আবারো ১৩ অ্যানথ্রাক্স রোগী সনাক্তঃ এলাকায় আতংক
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ শাহজাদপুরে মানব দেহে আবারো ভয়ংকর প্রাণী রোগ অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়েছে।...

মহাসড়কে চাঁদাবাজী দেখলেই গ্রেফতার- স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম
চন্দন কুমার আচার্য, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিঃ আসন্ন পবিত্র ঈদ-উল-আযহায় উপলক্ষ্যে মহাসড়কে চাঁদ...