বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪
TAJUDDINBarister Amirul Islam আবুল বাশার :- ২৫ মার্চ সারাদিন ধরেই নানা আশংকার খবর দেশব্যাপি প্রচারিত হচ্ছিলো। ইয়াহিয়া খানের সাথে সমঝোতাপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনা আর ছিল না। ৬ দফা ভিত্তিক সাংবিধানিক সমাধানের জন্য যে আলোচনা চলছিলো তা কতটুকু সদিচ্ছপূর্ণ ছিল সেটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ পায়। ইয়াহিয়া খান তার সঙ্গীদের উদ্দেশ্য ছিল তাদের অপারেশান সার্চ লাইট বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে সামরিক সরকার যে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং তারা যে হার্ড লাইনে যাচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছিলো। সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ির নিচতলার লাইব্রেরিতে টাক্সফোর্সের অফিস করা হয়েছিল । সেখানে টাক্সফোর্স ২৪ ঘন্টা কাজ করতো। ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন টাক্সফোর্সের সদস্য হিসেবে অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলিতে (১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ-১৯৭১) সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করতেন , বঙ্গবন্ধুকে ব্রিফিং দেয়া হতো এবং প্রেসে খবর পাঠানোর কাজ সেখান থেকেই করা হতো। তাজউদ্দীন ঔ টাক্সফোর্সের নেতৃত্ব দিতেন। দিনের শেষে সারাদেশের অসহযোগ আন্দোলনের সর্বশেষ পরিস্থিতি ও অবস্থা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে জানাতেন তাজউদ্দীন। টাক্সফোর্সের সাথে বৈঠক হতো ব্যাংকারদের,কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী সংগঠন, সরকারি কর্মকর্ত,ওয়্যারলেস কর্মকর্তা, যোগাযোগ ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে। অফিস-আদালতে ইত্যাদির জন্য প্রতিদিন কি নির্দেশ যাবে, তার পরিকল্পনা করা হতো। বঙ্গবন্ধুর সাথে আলাপ করে টাক্সফোর্র্স প্রতিদিনের নির্দেশণা তৈরি করতো। টাক্সফোর্সের একটা সিক্রেট প্লান ছিল যে, যখনই মিলিটারি টেক ওভার হবে তখন তাজউদ্দিন, ড.কামাল হোসেন ও ব্যারিষ্টার আমিরুল হোসেন একত্রিত হয়ে পরবর্তীতে কি করবেন সে বিষয়ে সিন্ধান্ত নেবেন। কনটিনজেনসি প্লান নিয়ে টাক্সফোর্সের মধ্যে আলোচনা হতো। প্লানের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা জরুরী মনে করলেন তাঁরা। সে মতে ব্যারিষ্টার আমিরুলকে সাথে নিয়ে তাজউদ্দিন তাদের কনটিনজেনসি প্লানের কথা বঙ্গবন্ধুকে জানালেন। বঙ্গবন্ধু ডাইরেকটিভ দিলেন না। বললেন, ‘এখন দেশ স্বাধীন হবে’। তোমরা নিশ্চিন্তে থাক। তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে বললেন আপনাকে নেতৃত্ব দিতে হবে। তিনি বললেন, আমাকে নিয়ে কোথায় যাবি, আমাকে খুঁজতে গিয়ে ওরা গ্রামগঞ্জ পোড়াবে, এইসব কথা বলনে তাঁদের। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁরা কি করবেনা সে নির্দেশনা দিলেন না বঙ্গবন্ধু। তাঁরা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, নন কোঅপারেশন মুভমেন্ট আর্মস ষ্ট্রাগলে পরিণত হতে যাচ্ছে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় তাজউদ্দীন কামাল হোসেন ও ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম একত্রে রিভিউ কমিটির মিটিং করার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর বাসার নিচতলার লাইব্রেরি রূমে। কিন্তু সেই সন্ধ্যায় মিটিং হলো না। ঐসময় তাজউদ্দিন ও ড. কামাল হোসেন সেখানে আসেননি। এদিকে চারিদিক থেকে সেদিন নানা রকমের আতংকের খবর আসছিলো। সন্ধ্যায় বের হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুর ঝঢ়ববপয ফৎধভঃ করে , ফাইনাল করে ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি আমিনুল হক বাদশাকে দেন সাইক্লোস্টাইলে প্রিন্ট করতে। সাইক্লোস্টাইলে প্রিন্ট করা এই বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু ২৬ ও ২৭ মার্চ হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে বেড়িয়ে রাত ন’টা সাড়ে ন’টার দিকে ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম যান তাজউদ্দীনের বাসায়। তখন তিনি দেখেন বেগম নুরজাহান মুরশিদ বাইরের ঘড়ে বসা। তাজউদ্দীন তখন ভেতরের ঘড়ে ব্যাগ খোঁজা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তখন আমিরুল ইসলাম তাঁর নিজের গাড়ীতে করে বেগম নূরজাহান মুরশিদকে তার ইউনিভার্র্সিটির কোয়ার্টারে নামিয়ে দিতে যান। তাঁকে নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফেরার পথে তিনি দেখেন, হোটেল শেরাটনের (হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল) রেডিও পাকিস্তানের অফিস আর্মিরা টেক ওভার করেছে। তারা দলে দালে ট্রাক থেকে নামছে। তখনই পাশে ৩ নম্বর সার্কিট হাউজে কামাল হোসেনর বাসায় ঢুকে পড়েন। তাঁকে রেডি হতে বলে ৪ নম্বর সার্কিট হাউসে তাঁর নিজ বাসায় ঢুকে তিনি প্রস্তুতি নিয়ে কামাল হোসেনকে সাথে নিয়ে গাড়ী চড়ে বাসা থেকে বেড় হয়ে পড়েন। তখন রাস্তা রাস্তায় বেরিকেড পড়েছে। বেরিকেডের কারনে তাঁরা শাহবাগের রাস্তায় যেতে পারলেন না। পওে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভীতর দিয়ে ছাত্রদের সহযোগিতায় গাড়ি নিয়ে ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসায় গেলেন। তখন রাত প্রায় সাড়ে দশটা। গিয়ে দেখলেন বঙ্গবন্ধু ও তার পার্সনাল এইড হাজী গোলাম মোরশেদ নিচতলার ডাইনিংরূমে বসা। সে সময় বঙ্গবন্ধু খুব clam I Relaxed ছিলেন। ওনার পরনে গেঞ্জি । তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে তাঁদের সাথে যাবার জন্য আহ্বান জানালেন। তিনি বললেন, না, অমি কোথাও যাবোনা। এখানেই থাকবো। Whatever happends I will face it . তিনি ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে কথাটি বললেন। তাঁরা আবারো বললেন, তাহলে আমরাও যাবো না। আপনার সাথেই থাকবো। এরার বঙ্গবন্ধু বেশ দৃঢ় স্বরে বললেন, Both of you are oath bound to obey my order. You must leave my house. God bless you. এ কথা বলে তিনি তাঁদের কাঁধে হাত দিয়ে হেটে গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাস্ট স্টেপ-এ এসে তাঁদের বিদেয় দিলেন। যখন তাঁরা বেড়িয়ে যাচ্ছিলেন তখন ছাত্র নেতা তোফায়েল আহমেদ ঢুকছেন। তোফায়েলকে তাঁরা বললেন, বঙ্গবন্ধুকে বের করতে চেষ্টা করলাম, তিনি বের হলেন না। এবার তুমি দেখ। এরপর তাঁরা দু’জন গাড়ি চালিয়ে তাজউদ্দীনের বাসায় গেলেন। তিনি তখন বাড়ির লনে অস্থির ভাবে পায়চারি করছিলেন। আমরিুল ইসলাম তাজউদ্দীকে তাদের সাথে যাবার জন্য আহবান জানালেন। তিনি বললেন, কি করবো ? কোথায় যাব ? তাঁর মুখে ছিল প্রচন্ড অভিমান। বোঝা গেল তিনি নেতার কাছ থেকে কোন নির্দেশণা পাননি। তখন ওনাকে জানানো হলো পাক আর্মি রাজারবাগ ও ইপিআর টেক ওভার করেছে। আজ রাতের অবস্থা অন্যরকম হতে যাচ্ছে। ঠিক সে সময় আওয়ামীলীগ সমর্থক এক ব্যক্তি দৌড়ে বাসার সামনে এসে উত্তেজিত কন্ঠে জানালেন যে আর্মিরা ইপিআরকে ডিসআর্ম করেছে। এ কথা শোনার পরই তাজউদ্দিন মত পরিবর্তন করলেন। ইতোমধ্যে পথের সমস্ত আলো নিভে গেছে। তাজউদ্দিন তাদের অপেক্ষা করতে বলে উপড়ে গেলেন। এরমধ্যে কামাল হোসেন তাঁকে ১৩ নম্বর রোডে তাঁর এক আত্নীয়ের বাসায় নামিয়ে দেয়ার জন্য তাগাদা দিতে থাকলেন। এর মধ্যে তাজউদ্দিন ওপর থেকে নেমে আসলেন। তাঁর কাঁধে রাইফেল, একটা থলি ও কোমড়ে ম্যাগজিন ভরা পিস্তল। তাজউদ্দীনের সাথে আমিরুল ইসলামের কথা হয়েছিল সশস্ত্র বিপ্লবে যাবার। ইতোমধ্যে তিনি অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং রাইফেল জোগার করেছেন ওনার বন্ধু ও সহকর্মী আরহাম সিদ্দিকীর মারফত। তাঁরা তিনজন একসাথে বাসা থেকে বেড় হলেন। কামাল হোসেন কিছুতেই তাঁদের সাথে থাকতে চাইলেন না। ওনার জোরাজুরির কারনে ওনাকে ধানমন্ডির রোডে ওনার এক আত্নীয়ের বাড়ীতে নামিয়ে দিয়ে তাঁরা দুজন যাত্রা শুরু করেন। পথে তাঁরা নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে দু’জন লাল মাটিয়ার রেলওয়ের সাবেক চিফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহন করেন। তাঁরা সেখানে আশ্রয় নেয়ার ৫/৭ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনবাহিনীর আক্রমন শুরু হয়। চারিদিকে ব্রাস ফাঁয়ারের শব্দ এবং মাণুষের মরণ আর্তনাদে কেঁপে কেঁপে ওঠে। মধ্যরাতে আকাশ ভড়ে যায় আগুন ও কালো ধোঁয়াতে। তারা সিন্ধান্ত নিলেন গফুর সাহেবের বাড়ীতে সেনা তল্লাসী শুরু হলে তাজউদ্দীন গফুর সাহেবের ঠিকাদার মোহাম্মদ আলী, ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম গফুর সাহেবের ভাতিজা রহমত আলী হিসেবে পরিচয় দেবেন। এমন প্রস্তুতি নিলেন বিপদের মোকাবেলা করার জন্য। এরপর গফুর সাহেবের বাড়ীর ছাদে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের আড়াল করে তাঁরা দেখলেন রাতের তান্ডবলীলা। পরে তাঁরা অন্যবাড়ীতে আতœগোপনের প্রাক্কালে পাকিস্তানি সৈন্যের হাতে লাল মাটিয়া পানির ট্যাংকের নিরাপত্তা প্রহরীকে প্রহৃত হতে দেখলেন। ট্যাংকের পানি সরবরাহ করার জন্য এই প্রহার। তাঁদের আতœগোপনের স্থানটি ছিল মোহাম্মদপুরের অবাঙালি বিহারি-অধ্যুষিত এলাকার কাছেই। তাঁরা মুখে রুমাল বাঁধা ও মাথায় উর্দি পরা বিহারিদেও পার্শ্ববর্তী বস্তীতে আগুন ধরিয়ে দিতে দেখলেন। আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বস্তির নারী পুরুষ ও শিশুরা তাদের ঝুপড়ি থেকে বেড়িয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ওপর পাকবাহিনীর অবিরাম ব্রাশ ফায়ার চললো। অশহায় নিরাপোরাধী মানুষের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের এ বর্বরতা তারা প্রত্যক্ষ করলেন। ২৭ মার্চ সকালে দেড় ঘন্টার জন্য কারফিউ তুলে নেয়া হয়। এ সময় তাঁরা সিন্ধান্ত নিলেন যে সাত মসজিদ রোড পার হয়ে রায়ের বাজারের পথ দিয়ে শহর ত্যাগ করবেন। লুঙ্গি,পাঞ্জাবি, মাথায় সাদা টুপি পরিহিত ও হাতে লোক দেখানো বাজারের থলির আড়ালে কোমড়ে গোঁজা পিস্তলের আড়াল করে তাাঁরা দু’জন চললেন গ্রামের উদ্দেশে। গফুর সাহেবের বাসায় ফেলে যান রাইফেলটি। গফুর সাহেব প্লাষ্টিকে মুড়ে সেটি মাটিতে পুঁতে রাখেন। যাবার পথে দৈবাত দেখা হয়ে যায় বাবু বাজারের পুলিশ ফঁড়ির কনষ্টবল রুস্তমের সঙ্গে। ঐ ফাঁড়িতে রাতের আঁধারে পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ চালিয়ে ঘুমন্ত কনষ্টবলদের গুলি করে হত্যা করেছে। সে কোন মতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। ঢাকা ছেড়ে বিভিন্ন গ্রামগঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পথে ২৮ মার্চ রাতে পদ্মার তীরবর্তী গ্রাম আগারগাঁওয়ে শুকুর মিয়া নামক আওয়ামীলীগৈর এক কর্মির বাড়িতে তাঁরা আশ্রয় গ্রহন করেন। ঐ বাড়ীর সকলেই তাঁতের ব্যবসার সংগে যুক্ত ছিল। সেখানে তাঁর গোসল সেরে রাতের খাবার খেতে বসেন। এসময় তাঁরা রেডিওতে শুনতে পান বাংলার সাড়ে-সাতকোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমানের ইংরেজিতে এবং পরেরদিন বাংলায় সম্প্রচারিত ঘোষণাটি তৎসময়ের রাজনৈতিক নেতাদেরসহ সামরিক ও বে-সামরিক সকল বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করে। পরদিন ভোরে তাঁরা দু’জন সে স্থোন ত্যাগ করেন। কখনো হেটে কখনো খেয়া নৌকায় ও রিকশায় চড়ে তাঁরা পথ চলতে থাকেন। ফরিদপুর শহরের সন্নিকটে পৌঁছার পূর্বে কিছু সময়ের জন্য তাঁদের ঘোড়াতেও চড়তে হয়েছিল। শহরের উপকন্ঠে পৌঁছে ঘোড়া ছেড়ে পরে তাঁরা রিকশা যোগে পৌঁছেন আওয়ামীলীগের নেতা ও এমপি ইমামউদ্দিনের বাড়ীতে। সেখান থেকে ৩০ মার্চ সকাল সাড়ে দশটায় তাঁরা ঝিনাইদহে পৌঁছালেন। সেখানে স্থানীয় আওয়ামীলীগ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য আব্দুল আজিজের বাড়ীতে তাঁরা আশ্রয় নিলেন। ঐ বাড়ীতেই তৎসময়ের মহুকূমা পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুবউদ্দিন আহমদের সাথে তাঁদের দেখা হয়। সে সময় মাহবুবউদ্দিন অত্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে ঐ এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাঁর স্থাপিত কন্ট্রোল রুম থেকে যশোর ও কুষ্টিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে সংবাদ বিনিময়ের কাজ চলছিলো। তখন মাগুরার প্রশাসক কামাল সিদ্দিকীও অত্যন্ত বীরত্বের সাথে মুক্তিসংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন দু’জনের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়েছিল। তখন পর্যন্ত ভারতের মনোভাব সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানেন না। যদি ভারত মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন না করেন তবে বাংলাদেশের মাটিতেই আতœ গোপন করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মানষিক প্রস্তুতি গ্রহন করেন তাঁরা। এররপর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি সহ কৃষকের বেশভূষায় তারা চুয়াডাঙ্গার দিকে রওনা হন। চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছে দেখা হয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ড. আসহাবুল হক, জাতীয় পরিষদের সদস্য আফজালুর রশীদ প্রমুখের সাথে। চুয়াডাঙ্গায় ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এর অসীম সাহসী কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে তখন প্রবল প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। মেহেরপুরের মহুকূমা প্রশাসক তৌফিক-এ-ইলাহী চৌধুরীও সে সময়ে সর্বতোভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করছেন। তখন সাধারণ মানুষেরা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করছে। ৩০ মার্চ বেলা প্রায় ৩ টা। ভারত সীমান্তের উদ্দেশে যেতে যেতে তাঁরা চিন্তা করলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রসঙ্গে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের। এ জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে তৌফিক-এ-ইলাহী চৌধুরী ও মাহবুব উদ্দিন আহমদকে ভারতে পাঠানো যুক্তিযুক্ত বলে তাঁরা মনে করলেন। তৌফিক-এ-ইলাহী চৌধুরী ও মাহবুবউদ্দিন আহমেদ চলে গেলেন ভারতে। তাঁরা দায়িত্ব সহকারে তাজউদ্দীনের ঐতিহাসিক বার্তাটি পৌঁছে দিয়েছিলেন ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছে। কুষ্টিয়া জেলার জীবন নগরের কাছে এবং পশ্চিমবঙ্গের নদীয় জেলার সীমান্তবর্র্তী ঐ স্থানটির নাম টুঙ্গি। তখন জায়গাটি ছিল প্রায় জনমানবহীন। সীমান্তের পাশে ঝোপ-জঙ্গল ও তার পাশ দিয়ে চলমান ছিল শীর্ণকায় খাল। খালের ওপর ছিল একটি কালভার্ট। কালভার্টেও ওপড়ে বসেই অপেক্ষমান ছিলেন দু’জন। পড়ন্ত বেলা । সূর্য ডোবার সময় ঘনিয়ে আসছে। ওপাড়ে গিয়ে তৌফিক ও মাহবুব এর সাথে দেখা হলো ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তা মহাপাত্রের সাথে। তিনি দু’জনের কাছ থেকে পুরো ঘটনা জেনে ভারতীয় সীমান্ত্ রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা তখনি সংবাদ প্রেরন করেন তাঁদের বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান আইজি গোলক মজুমদারকে। এরপর সম্পূর্ণ সামরিক কায়দায় স্বাধীন রাষ্ট্রের এই দুই প্রতিনিধিকে গার্ড অব ওনার প্রদান করে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতীয় সীমান্ত চৌকিতে। সন্ধ্যা আট টার দিকে গোলক মজুমদার গাড়ি করে কোলকাতা থেকে টুঙ্গিতে উপস্থিত হন। তখন তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিষ্টার আমিরুলের পড়নে ছিল ময়লা গেঞ্জি ও লুঙ্গি। ক্লান্ত মুখে চার-পাঁচদিনের দাঁড়ি-গোফ ও পায়ে রাবারের ছেড়া চটি। একেবারে কৃষকের সাজ। অনাহারে অর্ধহারে শরীর দূর্বল। কন্ঠস্বর ক্ষীণ। প্রথম সাক্ষাতেই তাজউদ্দীন জানালেন, দেশের ভেতরেই প্রতিমূহুর্তে বিশ্বাসঘাতকতা ও বিপদের ঝুকি থাকা স্বত্ত্বেও তিনি ভারতে আশ্রয় নিতে অনাগ্রী। কেননা বঙ্গবন্ধুর সুস্পষ্ট নির্দেশ যে, ভারতই বাঙালির শেষ ভরসা। সুতরাং এমন কিছু যাতে না করা হয় যাতে ভারত বিব্রত বোধ করে। গোলক মজুমদার বললেন পূর্বপাকিস্তানে থাকা তাঁর জন্য নিরাপদ নয়। যোগ্য নেতার অভাবে গণবিক্ষোভ স্তিমিত হয়ে যাবে এবং তিনি এলে ভারত কোন সময়েই বিব্রত বোধ করবে না। গোলক মজুমদারের সাথে আলাপের প্রাথমিক পর্যায়েই তাজউদ্দিন ও আমিরুল ইসলাম শরণার্থীদের আশ্রয়, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের জন্য ভারত সরকারের সাহায্য ও সহযোগিতার আবেন জানান। গোলক মজুমদার জানিয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে ছোট খাট কিছু অস্ত্র যোগার করা সম্ভবপর হলেও বড় পর্যায়ের সাহায্যের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের প্রয়োজন আছে। তখন আলাপ আলোচনা শেষে আমিরুল ইসলাম সহ তাজউদ্দিন জিপে করে তার সংগে কোলকাতা রওনা হন। তৌফিক ও মাহবুব ফিরে গেলেন কুষ্টিয়ায়। পকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশানের প্রস্তুতি নিতে। জিপ গাড়ীটি সোজা গিয়ে থামলো দমদম বিমানবন্দরে। এসময় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর প্রধান কে, এফ রোস্তমজি দিল্লি থেকে বিমানে করে সেখানে এসে পৌঁছালেন। গোলক মজুমদার কোলকাতা রওনা হওয়ার পূর্বেই রোস্তমজির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের বর্তমান অবস্থা ও আবেদন সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। এরপর রোস্তজিসহ তাঁরা উঠলেন কালো অ্যাম্বাসেডর গাড়িতে। তাদের নেয় হলো ছিমছাম একটি সুন্দর বাড়িতে। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর অফিসারদের জন্য সংরক্ষিত ঐ বাড়ীটির নাম ছিল আসাম ভবন’। তাদের কোন পরিধেও বস্ত্র না থাকার কারনে রোস্তমজি সুটকেস খুলে তাঁর পোষাক তাঁদের পড়তে দিলেন। প্রায় শেষরাতে তাঁরা সামান্য কিছু খাবার খেয়ে আলোচনায় বসলেন। পরদিন সকালে নিরাপত্তা অফিসার শরবিন্দু চট্রোপ্যাধ্যায় সেখানে উপস্থিত হলেন। পুরো সময়টিতে শরবিন্দু চট্রোপ্যাধ্যায় অত্যান্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। পরিচয় পর্বের পর তাঁর সহায়তায় তাজউদ্দিন ও আমিরুল ইসলামের জন্য প্রয়োজনীয় শার্ট-প্যান্ট, ব্যক্তিগত ব্যবহার সামগ্রী ও তাজউদ্দীনের ডাইবেটিকস্ এর ঔষধের ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্যে রোস্তমজি দিল্লিতে যোগাযোগ করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীনের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর আস্থাভাজন ছিলেন। এদিন তারা দুজন আবার ফিরে যান টুঙ্গির সীমান্তে। সেখানে বিএসএফ এর সহায়তায় কিছু অস্ত্র মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর হাতে তুলে দেয়া হয়। গোলক মজুমদার একটি এলএমজি তাজউদ্দীনকে দিয়েছিলেন। তিনি ঐ এলএমজিটি আবু ওসমানের হাতে তুলে দিয়ে তাজউদ্দিন বলেছিলেন, এটা আপনি সামলাবেন। সে সময় ইপিআর এর সুবেদার মুজিবর রহমানকে এলএমজি ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এসময় গোলক মজুমদার তাজউদ্দীনের উদ্দেশ্যে বলেন, Ô you will win’ । ১ এপ্রিল রাত ১০ টায় একটি মালবাহি সামরিক বিমানে তাজউদ্দীন ও আমিরুল ইসলাম গোলক মজুমদার ও শরবিন্দু চট্টোপাধ্যায় সকলের চোখ এড়িয়ে দিল্লির পথে রওনা হলেন। পুরানো AN12 রাশিয়ান বিমানটি প্রচন্ড আওয়াজ ও কাঁপুনি তুলে ধীর গতিতে যখন দিল্লি এয়ারপোর্টে পৌঁছালো তখন প্রায় ভোর হয়ে গেছে। সেখানে গিয়ে তাদের সাথে দেখা হলো বাংলাদেশ থেকে আগত কয়েকজন বুদ্ধিজীবি ও রাজনীতিবিদ রেহমান সোবহান,আনিসুর রহমান, আবদুর রউফ, এম,আর,সিদ্কিী, সিরাজুল হক প্রমুখের সাথে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (RAW) তাঁদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার জন্য বাংলাদেশ থেকে আগত রাজনীতিবিদদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এবং গোপনে তাজউদ্দীনের বিষয়টি নিশ্চিত হন যে তিনিই মূল ব্যক্তি। এরপর ৩ এপ্রিল রাত দশটায় ১০ নম্বর সফদার জং রোডে ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে তাজউদ্দিনের সাক্ষাত হয়। সেখানেই আলোচনা শেষে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের রূপরেখা তৈরী করা হয়। তথ্যসূত্র- তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা, মূল ধারা ৭১ (বই থেকে)।

সম্পর্কিত সংবাদ

শাহজাদপুর খুকনী বহুমুখী উচ্চ কিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত

শিক্ষাঙ্গন

শাহজাদপুর খুকনী বহুমুখী উচ্চ কিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত

শামছুর রহমান শিশির, নিজস্ব প্রতিবেদক : সিরাজগঞ্জের তাঁতসমৃদ্ধ শাহজাদপুর উপজেলার খুকনী ইউনিয়নের খুকনী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যা...

শাহজাদপুরে লোকনাট্য উৎসব অনুষ্ঠিত

শিল্প ও সাহিত্য

শাহজাদপুরে লোকনাট্য উৎসব অনুষ্ঠিত

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ শাহজাদপুরে গত বৃহস্পতিবার রাতে লোকনাট্য উৎসবের আয়োজন করা হয় । শাহজাদপুর মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় চত্বর...

শাহজাদপুরে চলছে মখদুমিয়া জামে মসজিদের উন্নয়নের কাজ

শাহজাদপুর

শাহজাদপুরে চলছে মখদুমিয়া জামে মসজিদের উন্নয়নের কাজ

মোঃ শফিকুল ইসলাম ফারুক : প্রায় সাড়ে আট শত বছরের পুরাতন হযরত মখদুম শাহ্দৌলা শহীদ ইয়েমেনী (রহঃ) এর পবিত্র মাজার সংলগ্ন মখদ...

শাহজাদপুরে তথ্য অধিকার বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত

তথ্য-প্রযুক্তি

শাহজাদপুরে তথ্য অধিকার বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ আজ মঙ্গলবার দিন ব্যাপী সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার হলরুমে তথ্য অধিকা...

শাহজাদপুরে বাংলা লোকনাট্য উৎসব হচ্ছে আজ

শাহজাদপুরে বাংলা লোকনাট্য উৎসব হচ্ছে আজ

ডেস্ক রিপোর্টঃ হাতের মুঠোয় হাজার বছর, আমরা চলেছি সামনে, এসো প্রাণের আলোয় করি দূর...

শাহজাদপুরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৯তম মৃত্যু বার্ষিকী পালিত

শাহজাদপুরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৯তম মৃত্যু বার্ষিকী পালিত

মোঃ শফিকুল ইসলাম ফারুক,শাহজাদপুরঃ আজ বৃহস্পতিবার সকালে শাহজাদপুর রবিন্দ্র কাছারি বাড়ী মি...