‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের ছোটনদী হারিয়েছে তার ঐতিহ্য। দিনে দিনে দখলে দখলে সংকুচিত ও শুকিয়ে মরে যাওয়ায় ছোটনদী (খোনকারের জোলা) তে বর্তমানে ‘সোনার তরী’ আর ভাসার উপায় নেই! চলতি বছরের ১৫ অক্টেবর শাহজাদপুরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারিবাড়ি পরিদর্শন শেষে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী এমপি ছোটনদীসহ শাহজাদপুরে কবিগুরুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সকল স্মৃতি সংরক্ষণে যথাযথ উদ্যোগ নেয়ায় আশ্বাস দেন। কিন্তু, এর প্রায় ২ মাস পেরিয়ে গেলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। প্রতিমন্ত্রীর দেয়া ছোটনদী সংরক্ষণের উদ্যোগের বিষয়টি আশ্বাসেই থেকে যাওয়ায় রবীন্দ্রানুরাগী ও রবি ভক্তদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তারা কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত ছোটনদী পূনরুদ্ধার করে এর স্বাভাবিক গতি প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় এমপি প্রফেসর মেরিনা জাহান কবিতা’র হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
জানা গেছে, প্রাচীনকাল থেকে প্রবাহিত করতোয়া ও বড়াল নদীর সঙ্গে সংযুক্ত এবং শাহজাদপুর শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাাহিত ছোটনদী বা খোনকারের জোলাটি অবৈধ দখলমুক্ত করে পুনঃখননের উদ্যোগ নেয় সরকার। ‘আমাদের ছোট নদী, চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার, হাঁটু জল থাকে’- স্থানীয়ভাবে প্রচলিত রয়েছে বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুরের কাছাড়িবাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া এই ছোট নদীকে নিয়েই কবি লিখেছিলেন এই কবিতাটি। অবৈধ দখল হওয়ার পূর্বে কবিতার সাথে হুবহু মিল ছিল এই খোনকারের জোলাটির। ৮০ দশকে অবৈধ সামরিক সরকার খাল খননের ধুয়া তুললেও রবি ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত খোনকারের জোলাটি সেই সময়ে অধিক মূল্য দেখিয়ে ভূমি দখলের কু-মতলব নিয়ে ভরাট করে। এর আগে বর্ষাকালে ছোটনদীর ওপর দিয়ে নৌকা ভাসিয়ে আশপাশের গ্রাম থেকে নৌকাযোগে শাহজাদপুরে আসতেন অনেকেই। ১৮৯০ সাল থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারী দেখাশোনার কাজে বিভিন্ন সময় কোলকাতা থেকে তার পদ্মাবোটে পদ্মা বড়ালের বুক বয়ে করতোয়ায় এসে নামতেন এই খোনকারের জোলার পূর্ব মুখে। সেখান থেকে পানসি নায়ে ঠাকুর আসতেন জমিদারির কাছারিবাড়িতে। আবার অনেক সময় কবিগুরু কাছাড়িবাড়ি থেকে ছোটনদীর বুকে পানসি ভাসিয়ে রাউতারাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমন করতেন। কিন্তু, কালের আবর্তনে খোনকারের জোলাটি অবৈধ দখল হয়ে যাওয়ার পর থেকে এটি মূলত পয়ঃনিষ্কাশনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ইতিপূর্বে, মোহাম্মদ হাসিব সরকার শাহজাদপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে থাকাবস্থায় খোনকারের জোলাটির নির্দিষ্ট স্থান জরিপের মাধ্যমে ছোটনদীর সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবহিত করেন। তিনি খোনকারের জোলার ৩ কি:মি: এলাকা পরিদর্শন করে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে প্রসংশনীয় ভূমিকা রাখেন। কিন্তু তার বদলীর পর থেকে অদৃশ্য কারণে খোনকারের জোলা দখলমুক্ত করণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে ছোটনদী পূণরুদ্ধারে কাউকেই কোন উদ্যোগ বা ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালের ভয়াবহ বন্যার পর খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে ১৯৫৭ সালে জাতিসংঘের অধীনে ক্রুগ মিশন এর সুপারিশক্রমে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের লক্ষে ১৯৫৯ সালে পূর্ব পাকিস্থান পানি ও বিদ্যূৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ইপিওয়াপদা) গঠন করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) ইপিওয়াপদা এর পানি উইং হিসাবে দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রন,পানি নিষ্কাশন ও সেঁচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কৃষি ও মৎস সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে দেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রধান সংস্থা হিসাবে কার্যক্রম শুরু করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-৫৯ মোতাবেক ইপিওয়াপদা এর পানি অংশ একই ম্যান্ডেট নিয়ে বাংলাদেশ বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাইবো) সম্পূর্ণ স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর পর্যায়ক্রমে সংস্কার ও পুনর্গঠনের ধারাবাহিকতায় জাতীয় পানি নীতি-১৯৯৯ ও জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা-২০০৪ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাপাউবো আইন-২০০০ প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের আওতায় পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী’র নেতৃত্বে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট পানি পরিষদের মাধ্যমে বোর্ডের শীর্ষ নীতি নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নদী ভারতের মরুকরণ প্রক্রিয়ার ফলে শুষ্ক মৌসুমে যৌবন হারিয়ে কবিগুরুর ছোটনদীসহ, যমুনা, পদ্মা, করতোয়া, বড়াল, হুরাসাগর, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুর, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোট যমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাইসহ উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীগুলো পানিশূন্য প্রায় হয়ে পড়েছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অতীতের তুলনায় উদ্বেগজনক হারে নীচে নেমে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি শাখা নদী,খাল-বিল শুকিয়ে গেছে। এসব তীরবর্তী অঞ্চলের চাষাবাদে এর কুপ্রভাব পড়ছে। এ কারণে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশংকা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কবিগুরুর ছোটনদীর মতো এ অঞ্চলের এক সময়ের ভয়াল, উত্তাল অনেক নদ-নদী ও শাখানদী বক্ষে এক ফোটাও পানি আর দেখা যাচ্ছে না।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশে আগত নদ-নদীগুলোর স্বাভাবিক গতিপথ রূদ্ধ করে দেওয়ায় সুজলা-সুফলা, শষ্য-শ্যামলা বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে মরু অঞ্চলে পরিনত হতে চলেছে যা এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশকে করছে ভারসাম্যহীন। এসব কারণে এ অঞ্চলের নদ-নদীগুলোর গতি প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটছে। আমরা হারাতে বসেছি আমাদের অনেক গ্রামীন ঐহিত্য। আবহমান কাল থেকে গ্রামীন জনপদের মানুষের প্রিয় সুস্বাদু দেশী মাছ এখন সোনার হরিণের মতো। এখন আর দেখা যায়না গ্রামীন ঐহিত্যের অনুসঙ্গ নৌকা বাইচ, খরা জাল, সূতি ফাঁদ, সেঁচের মাধ্যম দাঁড়। একইভাবে, দখল, দুষণ আর সংরক্ষণের অভাবে কবিগুরুর ছোটনদী
সংকুচিত হতে হতে মরা খালে পরিণত হওয়ায় রবীন্দ্র ভক্ত ও অনুরাগীদের মনে প্রশ্ন জেগেছে,‘কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত ছোটনদীতে ভাসবে কী আর সোনার তরী!’
সম্পর্কিত সংবাদ
অপরাধ
শাহজাদপুরে অটোবাইক ছিনতাই চক্রের ৬ সদস্য আটক
সিরাজগঞ্জ শাহজাদপুরে ছিনতাই হয়ে যাওয়া দুটি অটোবাইক উদ্ধারসহ অটোবাইক ছিনতাই চক্রের ৬ সদস্যকে আটক করেছে থানা পুলিশ। সোমবার...
১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ভূয়া এজেন্ট উধাও
স্টাফ রিপোর্টারঃ শাহজাদপুর উপজেলাসহ পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার ৩৯ জন হজ্জ যাত্রীর ১ কোটি ৫...