৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকেই রণাঙ্গনে যুদ্ধের রণকৌশল বদলে যায়। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ও মিত্রবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারাও হিট এন্ড রান গেরিলা যুদ্ধের রণকৌশল বাদ দিয়ে তাদের ক্যাম্পগুলোর কাছাকাছি থানাগুলো আক্রমণ করে থানা দখল নিতে সশস্ত্র হামলা ও যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ডিসেম্বর মাসের মাঝামঝি সময়কালে বৃহত্তর পাবনার বেশ কয়টি থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পূর্বাঞ্চলে সোনাতনীর ধীতপুরে হানাদার পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধ শেষে পাকবাহিনী হতাহত হয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর চর কৈজুরী গ্রামে ব্যারিষ্টার কোরবান আলী বাড়ীতে এবং কৈজুরী শাহজাদপুর সিএন্ডবি সড়কে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালালে রাজাকারা অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। এর পর থেকেই শাহাজাদপুরের পূর্বাঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। এ অঞ্চলটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকাশ্যে অবাধ বিচরণ শুরু হয়।
পরবর্তীতে শাজজাদপুর নরিনার জুগনীদহ ব্রীজে বাঙ্কার স্থাপন করে ব্রীজ পাহাড়ারত রাজাকারদের উপর মুক্তিযোদ্ধারা রাতে আক্রমণ করে। কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর তিন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। বাকিরা পালিয়ে যায়। পরের দিন আত্ম সমর্পনকারী এক রাজাকারকে ছেরে দেয়া হয় বাদবাকি রাজাকারদের অস্ত্র ও গুলি সহ আত্মসমর্পণে সম্মত করতে। এরপর তার মাধ্যমে বাকিরা অস্ত্রসহ শাহজাদপুরের করতোয়া নদীর শিবরামপুর খেয়াঘাটে খেয়া নৌকা পার হয়ে এসে দুই দফায় শ্রীফলতা গ্রামে এসে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
১২ ডিসেম্বর রাতে যুদ্ধকালীন কমান্ডার আবুল বাশারসহ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর আসে উত্তর অঞ্চল থেকে পাকবাহিনী পিছুহটে নগরবাড়ী আরিচা হয়ে ঢাকা যাবার প্রস্তুতি হিসেবে বাঘাবাড়ী বড়াল নদীপাড়ে এসে জমায়েত হচ্ছে। একদল একদল করে গাড়ী মাল সামান সহ পার হচ্ছে তারা। যুদ্ধকালীন কমান্ডার আবুল বাশারসহ মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীকে আক্রমন করার লক্ষ্যে রাতেই প্রস্তুতি নিয়ে করতোয়া নদী পাড় হয়ে সেলাচাপরী গ্রামের আশে পাশে মাঠের মধ্য অবস্থান নেন। ঘন কুয়াশার কারনে সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছিলোনা। আমরা রাতে আক্রমনের সিন্ধান্ত পরিবর্তন করি। রাতে সেখানেই অপেক্ষারত থেকে অবস্থান বুঝতে চেষ্টা করেন মুক্তিযোদ্ধারা। শীত বস্ত্রহীন কন কনে শীতের মাঝে সারারাত খোলা আকাশের নীচে তাঁরা কাটান । ভোরেও ঘণ কুয়াশা। সূর্য উঠছে। ধীরে ধীরে কুয়াশা কেটে যাচ্ছে। মাঠের মধ্যে গ্রামের লোকজনের নড়াচরা পরিলক্ষিত হয়। মুক্তযোদ্ধাদের দল সব শরীষা মাষকালাই জমি সবুজ ফসলের মাঠের মধ্যে পজিশন নিয়ে পরে থাকেন । মুক্তিযোদ্ধাদের এক মুক্তিযোদ্ধকে পাঠানো হলো গ্রামের লোককে সাথে নিয়ে কৌশলে পাকবাহিনীর অবস্থান ও আক্রমন করার মত স্থান ওপশ্চাত ভূমি নির্ধারনের জন্য রেখি করতে। প্রায় ঘন্টাখানেক চলে যায় রেখি মানের খবর নেই। মুক্তিযোদ্ধারা হামাগুড়ি দিয়ে ধীরে নৌবন্দরের দিকে এগুতে থাকেন। এর মধ্যেই বাঘাবাড়ী বড়াল নদী ফেরিঘাটে পাকবাহিনীর ওপর শুরু হয় বিমান হামলা। মুক্তিযোদ্ধারা এমন আক্রমনের মুখোমুখি হয়ে হতভম্ব হয়ে পড়েন। যখন দ্রুত গতিতে প্লেন আসার শব্দ শুনে তারা মনে করেন যেন পাহাড় ভেঙ্গে পড়ছে। তিন দফা আক্রমণ শেষে বিমান হামলা বন্ধ হয়ে যায়। এবার শুরু হয়ে যুদ্ধকালীন কমান্ডার আবুল বাশারসহ মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের পালা। তাঁরা পাকবাহিনীর গুলি শুরু করেন। পাকবাহিনী গুলির প্রতি উত্তরের মাধ্যমে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। দিনভর গোলাগুলি চলে। বিকেলের দিকে হানাদার বাহিনীর গুলির শব্দ থেমে গেল। মুক্তিযোদ্ধদের দল হামলার কৌশল পরবর্তন করতে নৌকা যোগে বাঘাবাড়ীর বড়াল নদীর দক্ষিণপাড়ে পার হন। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে ঘাটের দিকে চলে যান। কাছাকাছি আসার পর তাঁরা দেখতে পান একটি সেনা জীপ দুটি সেনা লড়ি বেড়া থানার এলাকায় যাবার উদ্দেশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। অনেক অবাঙ্গালি পরিবারের সদস্য ছেলেমেয়েদের নিয়ে ট্রাকে উঠছে। সামনে সেনাবাহনীর গাড়ী প্রস্তুত। ওঠা শেষ হলেই যাত্রা শুরু করবে। মুক্তিযোদ্ধরা কারিগরি রেঞ্চের মধ্যে এসেই গুলি করতে শুরু করেন। তারা দ্রুত যে যেমন পারছে গাড়ীতে উঠেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনটি গাড়ী পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো। মুক্তিযোদ্ধরাও গুলি চালাতে চালাতে সামনে এগিয়ে যান। নদীর ঘাটে এসে দেখেন প্রচুর অস্ত্রগুলি বারুদ তারা ফেলে গেছে। সেগুলো নিজেদের দখলে নেন মুক্তিযোদ্ধরা। ঘাটপাড়ে দেখা গেল দুইটি ৫/৭ বছরে শিশু বাচ্চা পরে থেকে চিৎকার করছে। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম উর্দ্ধু্ভাষী ঐ দু'জনের মধ্য একজনের হাতে গুলিবিদ্ধ। অপরজন অক্ষত। তারা দুই ভাই। কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রামবাসী ধীরে এগিয়ে আসতে থাকলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। শিশু দুটির কি করা যায় তা ভাবছিলেন মুক্তিযোদ্ধরা। এমন সময় এলাকার এক নিঃসন্তান হাজী সাহেব শিশু দুটির দায়িত্ব নিলেন। আমরা উদ্ধারকৃত অস্ত্রসস্ত্রসহ নৌকায় করে রাতে সেলাচাপড়ী গ্রামে আসেন মুক্তিযোদ্ধরা। সেখানে আব্দুল হাই সরকারের বাড়ীতে রাতে থাকার সিন্ধান্ত নেন তাঁরা। কমান্ডার আবুল বাশার সাহেব তখন খুব ক্ষুধার্থ। হাই সরকার জনাব বাশার সাহেবের ঘনিষ্ট আত্মীয় রাতে সে বাড়ীতেই খাওয়া দাওয়া করেন তাঁরা। রাতেই লোক মারফত জানতে পারেন শাহজাদপুর থেকে রাজাকার চিপ সহ সব রাজাকাররা শাহজাদপুর ছেরে পালিয়েছে। সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নেই। থানা স্টাফ তাদের পরিবার পরিজন ফেলে পালিয়ে গেছে। শাহজাদপুর থানা এখন অনেকটাই শত্রুমুক্ত। শেষ রাতের দিকে মুক্তিযোদ্ধরা নৌকায় অস্ত্র গোলাবারুদ তুলে নিয়ে শাহজাদপুরের দিকে যাত্রা করেন। থানাঘাট পৌঁছতেই দেখা গেল মানুষজনের মুখের আনন্দের অনুভূতি। নদী ঘাটে নেমে পাঠান পাড়ার দিকে এগুতেই সাবেক ছাত্র নেতা জাফর ভাইয়ের সাথে দেখা। তাঁর কাছে থেকে বিস্তারীত খবর জানেন কমান্ডার আবুল বাশার সাহেব । তাঁর সহায়তা নিয়ে পাঠান পাড়ার সেলিম ভাইয়ের বাড়ীতে তাঁর খাটের নীচে অস্ত্র ও গুলি আন্যন্য জিনিষপত্র নিরাপদে রেখে শাহজাদুর কলেজে এবং রবীন্দ্র কাছারি বাড়ীর অবস্থা দেখতে যান যুদ্ধকালীন কমান্ডার আবুল বাশার সাহেব। রবীন্দ্র কাছারি বাড়ীতে পাকবাহনীর ক্যাম্প ছিল। দরগা পাড়া ছয়আনী পাড়া রাজাকার ক্যাম্প ছিল। সব ফাঁকা। রবীন্দ্র কাছারী বাড়ীতে পাকবাহিনীর ফেলে যাওয়া উচ্ছিষ্ট ও অত্যাচার নির্যাতনের চিহ্নগুলো রযেছে। রংপুর বগুড়া উল্লাপাড়া থেকে ঢাকা ফেরত যাত্রা পথে বিহারী এবং সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল শাহজাদপুর সরকারী কলেজ। সেখানে তাদের পদচিহ্ন ও পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট বিদ্যমান ছিল। কলেজের ইঁদার মাঝে আশে পোড়া টাকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরেছিল। অস্ত্রগুলো আশে পাশের ডোবায় এবং কলেজের আশে পাশে অকেজো করে ফেলে গেছে তারা। বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ শহরে ঢুকতে শুরু করলো। এভাবেই শাহজাদপুর হানাদার রাজাকার মুক্ত হয়েছিল। পরে বি এল এফ নেতা আব্দুল বাকীকে মির্জাকে প্রশাসনিক প্রধান করে সিও ডেভ অফিসে বসানোর দায়িত্ব প্রদান করা হলো। সিনিয়র হিসেবে এফ এফ গেরিলা লীডার আব্দুর রউফ রাজা ভাইকে প্রশাসন সহযোগী বিচারকার্য পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করে শাহাদপুর কলেজ অধ্যক্ষের কক্ষে বসবার ব্যবস্থা করা হলো। যুদ্ধকালীন কমান্ডার আবুল বাশার সাহেব তাঁর যোদ্ধাদের নিয়ে শাহজাদপুর ইব্রাজিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করেন। তাঁদের অবদানে এদিনে অবশেষে পাকহানাদার মুক্ত হয় শাহজাদপুর।
শাহজাদপুর মুক্ত দিবসে জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান যুদ্ধকালীন কমান্ডার আবুল বাশার সাহেবসহ সকল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শাহজাদপুর সংবাদ ডটকমের্ পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা! আমরা কখনই তোমাদের ভূলবো না!
সম্পর্কিত সংবাদ
অর্থ-বাণিজ্য
শাহজাদপুরে গরু লালন পালন করে স্বাবলম্বী জোবেদা খাতুন
শাহজাদপুরে পোতাজিয়া গ্রামে ব্যবসায়ী আব্দুস সালামের শতাধিক গরু দেখাশোনা করেন তারই সহধর্মিণী জোবেদা খাতুন। মৌসুমী, বৃষ্টি,...
পড়াশোনা
শাহজাদপুরে ১৪৩ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ বিতরণ
নিজস্ব প্রতিনিধি: ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহার করে শ্রেণি পাঠদানের জন্য শাহজাদপুরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ বিতরণ কর...
অপরাধ
শাহজাদপুরে অটোবাইক ছিনতাই চক্রের ৬ সদস্য আটক
সিরাজগঞ্জ শাহজাদপুরে ছিনতাই হয়ে যাওয়া দুটি অটোবাইক উদ্ধারসহ অটোবাইক ছিনতাই চক্রের ৬ সদস্যকে আটক করেছে থানা পুলিশ। সোমবার...
ধর্ম
মহান ওস্তাদজী শাহ্ সামসুদ্দীন তাবরেজি (রহ.)'র দিনব্যাপী বাৎসরিক ওরশ শুরু
নিজস্ব প্রতিবেদক : আজ (বুধবার) সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর পৌরসদরের দরগাহপাড়া মহল্লাস্থ করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত মখদুমিয়া...
জানা-অজানা
কবিগুরুর ভাষ্কর্য ভালে পাকুড় বৃক্ষ জন্মেছে!
শামছুর রহমান শিশির: ঊনবিংশ শতাব্দিতে বাংলার সাহিত্য গগণে ও বিশ্ব জ্ঞান পরিমন্ডলে 'ভারস্যাটাইল জিনিয়াস' খ্যাত কবিগুরু রবী...
শাহজাদপুর
শাহজাদপুরে ট্রাক-সিএনজি মুখোমুখি সংঘর্ষ! নিহত ২
সিরাজগঞ্জ শাহজাদপুরে যাত্রীবাহী সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মাটি পরিবহনের ড্রাম ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে সিএনজির চালকসহ ২ জন...